–খনিমুখগুলো তাহলে নিশ্চয় সিল করে দিয়েছেন?
না কর্নেল। সিল করার সুযোগ পাইনি। মানে….একটু ইতস্তত করে ইন্দ্রনাথ মৃদু হেসে ফের বললেন–আমার অবশ্য কোনওরকম কুসংস্কার নেই। আপনি তা ভালই জানেন। কিন্তু আমার কাকা জগদীপ রায় হঠাৎ রহস্যজনকভাবে মারা পড়েন–ওঁর ডেড বডি খনির একটা সুড়ঙ্গে পড়ে ছিল–তারপর কাকিমা জেদ ধরলেন, খনিমুখ যেমন আছে তেমনি পড়ে থাক–তোমরা কেউ ওখানে যাবে না। কারণ কাকা নাকি খনিমুখগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা ঠিক করতেই গিয়েছিলেন ওখানে। আর, আপনি তো জানেন, কাকিমাই আমাদের ফ্যামিলির একমাত্র গার্জেন– কাকার অবর্তমানে। আমাদের ছেলেবেলা থেকে উনিই মানুষ করেছেন। ওঁর কথা আমাদের দু-ভাইয়ের কাছে ঈশ্বরের আদেশ। তাই আমরা আর ওদিকে মাড়াইনি।
কর্নেল বললেন–আপনার কাকিমার কী ধারণা হয়েছিল বলতে পারেন?
ইন্দ্রনাথকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন–একটু খুলে না বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। কাকা ছিলেন খেয়ালি মানুষ। মাছ ধরার বাতিক ছিল প্রচণ্ড। সীসের খনিটা রয়েছে তিনদিকে তিনটে পাহাড়ের মধ্যিখানে, একটি উপত্যকায়। খনির পেছনে আছে একটা হ্রদ। আসলে ওটা একটা নদীর বাঁকের মুখে, ন্যাচারাল ওয়াটার ড্যাম। পরে মুখটা চড়া পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হ্রদটা খুব গম্ভীর হওয়ার জন্য জল কখনও মরে না। আমরা খনিটা ছেড়ে আসার পর নদীতে একবার প্রচণ্ড বন্যা হয়। তখন হ্রদেও জল ঢুকে পড়ে এবং সেই জল খনির মধ্যেও ঢুকে যায়। কিছু কিছু খনিমুখ এর ফলেই আপনা-আপনি ধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল তিনটে খনিমুখ, একটু উঁচু জায়গায়। কাকা প্রতিবার অক্টোবরে ওখানে গিয়ে তার বাংলোয় কাটাতেন। বরাবরকার অভ্যাস। জায়গাটার সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, হ্রদে মাছ ধরার নেশা ছিল ওঁর। পাঁচবছর আগের অক্টোবরে কাকিমাকে নিয়ে উনি ওখানে যান। সেবারই খনিমুখ তিনটে বন্ধ করে আসার উদ্দেশ্য ছিল। সঙ্গে একজন ইঞ্জিনিয়ারও নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর কী হলো, ফোরটিনথ অক্টোবর সারা বিকেল মাছ ধরার পর ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে বলেন–আপনি বাংলোয় চলুন, আমি একটু পরে যাচ্ছি। তারপর অনেক রাত হলো, কিন্তু ফিরলেন না। তখন খোঁজাখুজি পড়ে গেল। হ্রদে স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসী জেলে রাতে মাছ ধরতে এসেছিল। তাদের সঙ্গে দেখা হলে জানাল সায়েবকে তারা খোলা খনিমুখের কাছে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালাতে দেখেছে। রাত তখন একটা। জেলেদের কথা শুনে…
কর্নেল বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-জেলেরা তো লেকে ছিল। কীভাবে জানল, উনিই আপনার কাকা?
ইন্দ্রনাথ বললেন নির্জন জায়গা। তাছাড়া ওখানে ভূত আছে বলে স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস। সব পোডড়া খনি কেন্দ্র করেই ভুতুড়ে গালগল্প গড়ে ওঠে। এখানেও তাই হয়েছিল। যাইহোক, এই জেলে তিনজন ছিল খুব সাহসী। বয়সে যুবক। টর্চের আলো দেখে ওরা পরস্পর তর্ক জুড়ে দেয় যে ওটা ভূত কিংবা ভূত নয়। তাছাড়া হ্রদটায় প্রচুর মাছ–অথচ ভূতের ভয়ে গরীব জেলেরা মাছ ধরতে ভয় পায়–পাছে ভূতের অভিশাপ লাগে। কিন্তু এই তিনটি সাহসী তরুণ আদিবাসী সে রাতে জেদ করেই এসেছিল। হারাতেই এসে এবং মাছ ধরে ওরা প্রমাণ করে দেবে যে ওখানে ভূতপ্রেত কিংবা অভিশাপ ব্যাপারটা মিথ্যে।
কর্নেল বললেন-তারপর?
–ওরা আলো লক্ষ্য করে ওখানে যায়। দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলে–কে ওখানে? তখন কাকার সাড়া পায়। কাকা ওদের সুপরিচিত। ফলে, ওরা কাছে না গিয়ে হ্রদে নিজের কাজে ফিরে যায়। যাই হোক, এই সূত্র ধরে সেই খনিমুখ তিনটের কাছে যাওয়া হলো। তারপর একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে কাকার লাশ পাওয়া গেল। কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই শ্বাসরোধ করেও মারা হয়নি। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে বলা হলো–হার্টফেল করে মারা পড়েছেন। অথচ কাকার স্বাস্থ্য ছিল খুবই ভাল।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর কর্নেল বললেন–কিন্তু আপনার কাকিমা খনিমুখ বন্ধ করতে নিষেধ করেন বলছিলেন। কেন–সেটা স্পষ্ট বুঝলুম না মিঃ রায়!
ইন্দ্রনাথ আনমনে মাথা নেড়ে বললেন কাকিমাও স্পষ্ট কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন–ওগুলো যেমন আছে, তেমনি থাক। আমার ছোট ভাই সৌমেন্দু ডাক্তার। ও এখন জব্বলপুরে সরকারী হাসপাতালের চার্জে আছে। কোনও কুসংস্কার নেই। ও জেদ ধরেছিল কাকিমার কাছে। কিন্তু কাকিমা শুধু বলেছিলেন–খনিতে এক সাধু আছেন তিনি নাকি অদৃশ্যও হতে পারেন। সেই সাধু নির্জনে তপস্যা করার জন্য খনির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন কবে। জবরদখল–যাকে বলে! …কথাটা বলে ইন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন।
আমরাও হাসলুম। কর্নেল বললেন–সাধুকে কেউ দেখেছে কখনও?
ইন্দ্রনাথ বললেন–না। আমার ধারণা, কাকিমার নিছক বিশ্বাস। তবে কেন এমন আজগুবি ধারণা হলো, তাও উনি বলেননি। বলবেনও না। খনিমুখ বন্ধ করলে সাধু নাকি রেগে যাবেন।
ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি নিয়ে এল। আমরা কিছুক্ষণ কফি খেলুম চুপচাপ। তারপর কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন–খুব ইন্টারেস্টিং!
ইন্দ্রনাথ বললেন–তবে কর্নেল, ওই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্যে আমি নিশ্চয় আপনার কাছে আসিনি। আমি এসেছি, স্রেফ মাছ ধরার প্রস্তাব নিয়ে। অবশ্য, আপনারই কাছে প্রস্তাব আনার কারণ যদি জানতে চান, তাহলে বলবকাকার মৃত্যুর পর থেকে প্রতিবছরই এই সময় আমার চিরিমিরি এলাকার ওই হ্রদে যেতে ইচ্ছে করে–অন্তত স্রেফ ছিপে মাছ ধরার জন্যে। অথচ বুঝতেই পারছেন, ওই ট্র্যাজিক ঘটনার ফলে একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। দ্বিধা এসে সামনে দাঁড়ায়। একা যেতে শেষ অব্দি সাহস পাইনে। ওদিকে কাকিমা জানতে পারলেও বাধা দেবেন। তাই অবশেষে আপনাকে নিয়ে যাবার প্ল্যান মাথায় এসে গেল। আপনারও মাছ। ধরার হবি ছিল এক সময়–দেখেছি।