ডঃ রায় গম্ভীর মুখে বললেন, আমার কোনও দুঃখ নেই। ওর শাস্তি হোক।
কর্নেল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, এই নিন মিঃ শর্মা! টাইপ করা চার ছত্র কবিতা আছে এতে। আমি নিজে টাইপ করেছি। তবে টাইপরাইটার ডঃ রায়ের। এবার অনুরাধাকে যে টাইপ করা চিঠি লিখে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল, তার টাইপ কেসের সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন। দুটো একই টাইপরাইটারে টাইপ করা। অরুণেন্দু আমার টাইপরাইটারটাই ব্যবহার করেছিল।
ডঃ রায় রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে বললেন, শুওরের বাচ্চা! ওর ফাঁসি হোক।
শর্মাজী হাসতে হাসতে বললেন, সে কী ডঃ রায়! নিজের ভাগ্নেকে শুওরের বাচ্চা বলছেন?
ডঃ রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কে নিজের ভাগ্নে? কোনও রক্তের সম্পর্ক আছে ভাবছেন নাকি? কলকাতায় আমার দিদির পাড়ায় থাকে। তাকে মাসি বলে সেই পাতানোর সম্পর্কে আমাকে মামা বলেছে। দিদির বয়স হয়েছে। একা মানুষ। ওই হতচ্ছাড়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল একবার। সেই থেকে আমি ওর মামা হয়ে গেলুম। মামা!
ডঃ রায় রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন।
শৰ্মাজী বললেন, কাল আপনার প্রোগ্রাম কী, কর্নেল?
ফুলঝরিয়া লেকে ছিপ ফেলা এবং বাগে পেলে দুটো অন্তত প্রজাপতি ধরা। বলে কর্নেল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
শৰ্মাজী বেরিয়ে বললেন, খামোকা বুড়ো-মানুষ মোহান্তজীকে টানাটানি করা হল। পরিণামে হয়তো বরাতে বদলি আছে। ওঁর মুরুব্বিরা প্রভাবশালী। তবে বারাহিয়া আর আমার সহ্য হচ্ছে না, কর্নেল! বদলিটা প্রয়োজন বলেই মনে করব। এমন হুজ্জুতে জায়গা আর কোথাও দেখিনি।
কর্নেল বললেন, আমার অবশ্য বারাহিয়াকে ভালই লাগে।
পুলিশ হলে ভাল লাগত না। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, সেজন্যই পুলিশ হইনি। মিলিটারিতে ঢুকেছিলুম।
খোকন গেছে মাছ ধরতে
সেদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমাকে দেখেই বলে উঠলেন–জয়ন্ত কখনওকি ছিপে মাছ ধরেছ?
সবে ওঁর ইলিয়ট রোডের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমের ভেতর পা বাড়িয়েছি, বেমক্কা এই প্রশ্ন। অবশ্য ওঁর নানারকম অদ্ভুত-অদ্ভুত বাতিক আছে জানি, কিন্তু ওঁর মতো ছটফটে মানুষ ছিপ হাতে ফাতনার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে বসে থাকবেন–এটা বিশ্বাস করা কঠিন। যাই হোক্ ধীরে সুস্থে বসার পর বললুম–আজ কি তাহলে কোথাও ছিপ ফেলার আয়োজন করেছেন কর্নেল?
কর্নেল হাসতে হাসতে ছড়া বলে উঠলেন :
খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেছে কোলাব্যাং
মাছ নিয়ে গেছে চিলে।…
অবাক হয়ে বললুম–আপনি এ ছড়া কোথায় শিখলেন? আপনি তো বাংলা পাঠশালায় পড়েননি।
কর্নেল এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন–ছড়াটা কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট! অপূর্ব! ভাবা যায় না! বেচারা খোকন বড় সাধে মাছ ধরতে বসেছে। এদিকে কি না দুষ্ট কোলাব্যাংটা তার ছিপখানাই নিয়ে পালাল? ওদিকে কোত্থেকে এক ব্যাটা চিল এসে…ভাবা যায় না! ভাবা যায় না!
কর্নেল ছড়ায় বর্ণিত দৃশ্য যেন চোখ বুজে দেখতে দেখতে খুব মুগ্ধ হয়ে তারিফ করতে থাকলেন এবং সেই সঙ্গে ওঁর প্রাণখোলা হাসি। ওঁর পরিচারক ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে থ।
কর্নেলের মধ্যে খোকাটেভাব আছে, বরাবর দেখেছি। কিন্তু আজ সকালে আমাকে জরুরি তলব দিয়ে ডেকে এনে নিতান্ত মাছ ধরার প্রোগ্রাম শোনাবেন ভাবিনি। আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার এবং কর্নেল এক ধুরন্ধর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার-সোজা কথায় গোয়েন্দাও। আশা ছিল, গুরুতর একটা ক্রাইম স্টোরি পেয়ে যাব। দৈনিক সত্যসেবকের আগামীদিনের প্রথম পাতাটা পাঠকদের মাত করে ফেলবে! কিন্তু এ যে দেখছি, নিতান্ত মাছধরার বদখেয়াল নিয়ে উনি বসে আছেন! আমার মতো ব্যস্ত রিপোর্টারের একটা দিনের দাম খুব চড়া। আমি হতাশ হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলুম।
হঠাৎ কর্নেল কোণের দিকে ঘুরে বললেন–মিঃ রায়, আলাপ করিয়ে দিই। এই আমার সেই প্রিয়তম তরুণ বন্ধু জয়ন্তার কথা আপনাকে বলছিলুম।
এতক্ষণ কোণের দিকে তাকাইনি। এবার দেখি, খবরের কাগজের আড়ালে এক সুদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক উজ্জ্বল ফর্সা রঙ, পরনে নেভিরু আঁটো পাতলুন এবং গায়ে টকটকে লাল স্পোর্টিং গেঞ্জি, ঠোঁটে আটকানো পাইপ, মুখ বের করলেন। ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা গোঁফে কর্নেলের মতো একটা সামরিক জীবনের গন্ধ মেলে। উনি কাগজ ভাঁজ করে রেখে তখুনি আমাকে নমস্কার করলেন। আমিও।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, উনি মেজর ইন্দ্রনাথ রায়। আমার সামরিক জীবনের বিশেষ স্নেহভাজন বন্ধু। সম্প্রতি রিটায়ার করছেন। এঁর জীবন খুব রোমাঞ্চকর, জয়ন্ত। সিক্সটি-টুতে চীনারা নেফাবর্ডারে এঁকে ধরে নিয়ে যায়। জঘন্য অত্যাচার করে। তারপর…
ইন্দ্রনাথ হাত তুলে হাসতে হাসতে বললেন–এনা কর্নেল! আমি আপনার মতো যোদ্ধা ছিলুম নাসুযোগও পাইনি। তাই অত কিছু বলারও নেই।
কর্নেল আপত্তি গ্রাহ্য না করে বললেন–তাছাড়াও এঁর একটা অভিজাত সামাজিক পরিচয় আছে, জয়ন্ত। ইনি মহিমানগরের প্রখ্যাত রাজপরিবারের সন্তান। মধ্যপ্রদেশের নানা জায়গায় এঁদের অনেকগুলো খনি ছিল। একটা বাদে সবই এখন রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন– ও একটা ডেড মাইন বলতে পারেন অবশ্য। ছেড়ে দিয়েছি আমরা।
কর্নেল প্রশ্ন করলেন–কিসের খনি যেন?
–সীসের। সাত বছর আগে ওটা পোড়া হয়ে গেছে। আর কিছু মেলেনি।