আচার্য ও সেনাপতি হাসলেন।
কর্নেল বললেন, আমার ধারণা–উনি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। মহিলাটি মাল নিয়ে কেটে পড়েন কি না ওঁর সে সন্দেহও ছিল। তাই সুমন্তর পরামর্শে তাকে লাগালেন ওয়াচডগ হিসেবে। কিন্তু তন্দ্রাও যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে! হা-হেরে যাওয়া মানুষ এইরকমই হয়ে থাকে। ভাবে, সবাই তাকে ঠকাবে। এবং সে কারণে তন্দ্রার ওপর ওয়াচডগ রাখলেন সুমন্তকে। আর সুমন্ত ওঁকে ঠকাল–সত্যি সত্যি ঠকাল। আসলে সুমন্ত তো তাই চেয়েছিল। নির্বোধ পানিগ্রাহী ওকে বিশ্বাস করে ঠকলেন। এর ফলে হলো কী জানেন? এরপর পানিগ্রাহীর অবশিষ্ট বিশ্বাসটুকুও চলে গেল মানুষের ওপর। এটা ভালই হলো।
পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু তাকে খুন করল কেন সুমন্ত?
খুব সঙ্গত ও স্বাভাবিক মোটিভ। কল্যাণীর সাক্ষে প্রমাণ পাচ্ছি, মালটা শেষ অব্দি যে-কোনওভাবে হোক–হয়তো মহিলাটির সঙ্গে যোগসাজস করে কিংবা তার ঘর থেকে চুরি করে সুমন্ত হাতিয়েছিল। তা টের পেয়ে ওকে কিছু বলে থাকবে। তা হয়তো পানিগ্রাহীর কানে তোলার জন্যে শাসিয়েছিল। তাই ওকে সরানোর দরকার হলো সুমন্তর। কিংবা কল্যাণীর হাতে মালটা তুলে দেওয়ার পর দুজনের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে থাকবে–যার পরিণামে আকস্মিক রাগেও ছুরি মারতে পারে সুমন্ত। ওর মতো ছেলের পক্ষে এটা খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। এখন সবটা নির্ভর করছে সেই মহিলাটি আর সুমন্তের কনফেশনের ওপর। পানিগ্রাহীর মুখ থেকে কথা বের করা কঠিন। ওঁর রাজনৈতিক অ্যামবিশান ওঁকে মরিয়া করেছে। সত্যি বলতে কী, আমাদের আজকের জীবনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই ট্র্যাজেডি এত ব্যাপক আর গভীর, কহতব্য নয়। তার প্রমাণ আমরা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে পাচ্ছি।
সেনাপতি বললেন, কর্নেল, ডোমপাড়ার চারজন লোক এসেছিল
কর্নেল বললেন, জানি। তারা তার লাশ বয়েছিল সুমন্তর কথায়।
লাশটা মর্গে চলে গেছে। সেনাপতি উঠে দাঁড়ালেন।…তার ঠিকানায় খবর গেছে। লালবাজারেও ওর ব্যাকগ্রাউণ্ড জানতে চেয়েছি। আজ রাতের মধ্যেই সব, পেয়ে যাব আশা আছে। তাহলে আপনি স্নানাহার সেরে নিন, আমরা সী ভিউতে গিয়ে সুইট এতে হানা দিই।
ওরা চলে গেলে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ডাঃ পট্টনায়ক, কল্যাণীকে বলুন–তার বন্ধু বিচ্ছেদের জন্যে যে বৃদ্ধটি দায়ী, তাকে যেন সে ক্ষমা করে।
কল্যাণী ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, বন্ধু না হাতি! ভাল হাত আছে গিটারে–তাই! ও গোল্লায় যাক! খুনী গুণ্ডা কোথাকার! বলে সে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, সত্যি, একালের ছেলেমেয়েদের আমরা বুঝতে পারিনে।
.
১১.
স্বীকারোক্তি
সমুদ্রতীরে আবার একটা বিকেল নেমেছে আজ। কিন্তু এ বিকেল বৃষ্টিধূসর। বিচ নির্জন। আকাশভরা ঘন মেঘ। মেঘ আর সমুদ্র সমানে গর্জন করছে।
থানার বড় ঘরটিতে বসে সুমন্ত তার জবানবন্দি দিচ্ছিল। কফেশন বা স্বীকারোক্তি বলাই ভাল। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার এক পাশে। অন্যপাশে ডাঃ পট্টনায়ক।
…পানিগ্রাহীদার ভাড়াটে মেয়ে মিস শান্তার ঘর থেকে গতকাল দুপুরে আমি ড্রাগের প্যাকেটটা হাতাই। তারপর..
কর্নেল বললেন, কিন্তু কীভাবে?
সুমন্ত চোখ তুলে নামাল। আস্তে বলল, তাহলে গোড়া থেকে ভ্যানর-ভ্যানর করতে হয়।
এটা ইমপরট্যান্ট, সুমন্ত। অবশ্য বলা না বলা তোমার খুশি। আমরা আইনত তোমাকে চাপ দিতে পারিনে, ইউ নো দ্যাট।
পানিগ্রাহীদার প্ল্যান ছিল, ২২ জুলাই রাতে কোনও একসময় প্যাকেটটা মিস শান্তা ভারতবাবুকে রাখতে দেবে। তারপর সে সুযোগ মতো শেষরাতে কেটে পড়বে। পানিগ্রাহীদাকে আমরা গিয়ে খবর দিলে উনি ব্যবস্থামতো অফিসারদের নিয়ে হানা দেবেন হোটেলে। আমি আর তন্দ্রা–দরকার হলে সাক্ষীও দেব। এদিকে তখন মিস শান্তা উধাও হয়ে যাবে ইত্যাদি সব প্ল্যান। এ হচ্ছে পানিগ্রাহীদার বরাবরকার রীতি। সব ব্যাপারে বিরাট প্ল্যান করেন। ভেস্তে যায় শেষ অব্দি। এমন অজাযুদ্ধ ঋষিশ্রাদ্ধ গোছের জবড়জং প্ল্যান করলে তাই হয়। ইলেকশানে তো ও জন্যেই হেরেছেন। নির্বোধ বহু দেখেছি, এমন আর নেই। জলের মতো টাকা খরচ করে…
তুমি নিজের কথা বলো, সুমন্ত।
এই নির্বোধ বড়লোকটার ওপর আমার বরাবর ঘৃণা ছিল। তাই ওকে ঠকিয়ে টাকা নিয়েছি সবসময়। এটা পাপ মনে করিনে।
প্লীজ, প্লীজ!
মিস শান্তা দুপুরবেলা খাওয়ার পর ঘুমোচ্ছিল। গিয়ে ঘণ্টা টিপলুম। দরজা খুলল। অমনি বের করলুম ড্যাগারটা। ড্যাগারের সামনে সে চুপ করে গেল। প্যাকেটটা তক্ষুনি বের করে দিল। তাকে বললুম– যদি এক্ষুণি না কেটে পড়ো, তো বিপদ হবে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে সামনেই সি সুইটে তন্দ্রার ঘরে ঢুকে গেলুম। দরজা খোলা ছিল–কারণ, আমি একটু আগে বেরিয়েছি। তন্দ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ওর প্রশ্নে উত্যক্ত হয়ে সংক্ষেপে সব জানালুম। তারপর…
একটা কথা। শান্তা তোমাকে চিনতে পারেনি?
না। ঘরে থাকার সময় ফিতে দিয়ে আটকানো বেলুন দুটো খুলে রাখতুম। শার্ট-প্যান্ট আর মুখোশ পরে ঢুকেছিলুম শান্তার ঘরে।
সুইটের দরজায় আইহোল আছে, সুমন্ত?
হ্যাঁ–সেতো ছিল। কিন্তু আমি সুইচ টিপে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিলুম। শান্তা ঝটপট দরজা খুলেছিল। বয় কিংবা ভারতবাবু ভেবে থাকবে ও। ভারতবাবুর সঙ্গে খুব খাতির জমিয়েছিল তো।