মালবিকা বললেন, কল্যাণী বেরিয়েছিল? সে কী!
হ্যাঁ। আপনাদের গ্যারাজটা বাগানের কোণে একটু দূরে কিন্তু আমি যে ঘরে ছিলুম, তার জানালা থেকে দেখা যায়। দেখলুম, কেউ বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে। ডাঃ পট্টনায়ক গেলেন–ভাবলুম। কিন্তু তার গলার আওয়াজ পেলুম শোবার ঘরে। আপনার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাহলে কল্যাণী ছাড়া আর কে হবে!
পট্টনায়ক ক্ষুব্ধভাবে বললেন, আশ্চর্য! ও কী যে করে–আমরা কিছু জানতে পারিনা।
কর্নেল বললেন, কল্যাণী, দিস ইজ ভেরি ভেরি ইমপরট্যান্ট। জবাব দাও, প্লীজ।
কল্যাণী আস্তে বলল, সুমন্ত আমাকে চিঠিতে সব জানিয়েছিল কলকাতা থেকে। জানিয়েছিল, ২২ জুলাই রাত্রে সে পানিগ্রাহীসায়েবের বাংলোয় থাকবে। আমাকে যেতে বলেছিল। কোন পথে কীভাবে যাব, তাও লিখেছিল। ২১ তারিখে চিঠিটা পাই। তারপর হঠাৎ শার্কের সামনে কাল বিকেলে ওকে মেয়ে সেজে বেড়াতে দেখি। সে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে। আর বলে যে রাত দশটার পর যেন ফার্মের বাংলোয় কথামতো যাই।
তাই কথামতো তুমি গেলে। কিন্তু কোন পথে গেলে?
হিলের উত্তর দিকটা ঘুরে। দক্ষিণ ঘুরে গেলে পথ ভাল ছিল কিন্তু ওদিকে যেতে বারণ করেছিল সুমন্ত। বলেছিল, আমাকে কিছু দামী জিনিসপত্র রাখতে দেবে–তার দাম নাকি, পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা। সোজা গেলে অত রাতে ও রাস্তায় গাড়ি দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারে–তাই উত্তর দিকের বালিয়াড়ি হয়ে যেতে হবে।
সুমন্তর ভয় ছিল পানিগ্রাহীর জন্যে। উনি ওই রাস্তাটা ব্যবহার করবেন, সে অনুমান করেছিল। তারপর?
আমি গিয়ে বাইরে গাড়ি রেখে ঢুলুম। অল্প আলো জ্বলছিল ঘরে। সুমন্ত দরজা খুলে দিল। সে আমাকে ঘরে ঢুকতেও দিল না। দরজার সামনে একটা মস্ত প্যাকেট গুঁজে দিয়ে বলল, শীগগির এটা নিয়ে যে-পথে এসেছ, চলে যাও। প্যাকেটটা লুকিয়ে রাখবে। আমি সকালে দেখা করব।
তুমি বেডরুমে তাহলে ঢোকোনি?
না। বাইরের ঘরের ভিতরই ঢুকিনি। ঢুকতে দিলে তো!
ঘরে কোনও মেয়ে ছিল, লক্ষ করেছিলে?
পর্দা থাকায় ভিতরটা দেখতে পাইনি। তবে–তবে আমার মনে হচ্ছিল, ঘরে আরও কেউ যেন আছে। কারণ, প্যাকেট নিয়ে চলে আসবার সময় ফিসফিস কথা কানে এসেছিল যেন। বৃষ্টির মধ্যে কানের ভুল ভেবেছিলুম।
সুমন্তকে তাহলে অন্ধকারে দেখেছিলে?
হ্যাঁ। আলো ভিতরে ছিল। প্যাকেটটা দিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল তক্ষুনি।
সুমন্তের পোশাক কি ভিজে মনে হচ্ছিল তখন? ভাল করে ভেবে বলল।
অতটা লক্ষ…না, ভিজে ছিল। কারণ, প্যাকেট নেবার সময় টের পাচ্ছিলুম, ওর হাত ভিজে। হ্যাঁ সম্পূর্ণ ভিজে অবস্থায় ও ছিল। একটু কাঁপছিল মনে হলো।
তারপর তুমি কী করলে?
বাড়ি ফিরে এলুম। গ্যারাজে গাড়ি ঢুকিয়ে প্যাকেটটা ডিকিতে রাখলুম।
সকালে এল সুমন্ত?
হ্যাঁ। তখন আটটা প্রায়। মা পাশের একটা বাড়িতে গেলেন। আমি একা ছিলুম। এসে বলল, চুল কাটতে দেরি হলো। প্যাকেটটা এবার চাই। আমার শরীরে কোল থেকে জ্বর জ্বর ভাব ছিল–এখনও একটু টেম্পারেচার। রাতে ভিজেছিলুম একটুখানি। তা, সুমন্তকে চাবি দিলুম গ্যারাজ আর গাড়ির। সে চলে গেল। খানিক পরে জানালা দিয়ে চাবির রিঙটা গলিয়ে ফেলে বলল, পরে দেখা হবে। কাকেও কিছু বলল না। ওর কাঁধে একটা কিটব্যাগ দেখলুম।
সেনাপতি বললেন, কিটব্যাগে তাহলে প্যাকেটটা ভরেছিল। আর ছোরাটা ইঞ্জিনের মধ্যে রেখে কল্যাণী বা ডাঃ পট্টনায়ককে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। কর্নেল, প্যাকেটটায় কী থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?
কর্নেল বললেন, নিষিদ্ধ ড্রাগ।
সে কী! কোথায় পেল সে?
পানিগ্রাহী ভারতকে ঢিট করতে চেয়েছিলেন। তাই নিজের ট্যাকের কড়ি দিয়ে যোগাড় যন্ত্র করে সী ভিউ হোটেলে পাচার করার মতলব ছিল। ওঁর সুইডেন যাওয়াটা আকস্মিক ব্যাপার নয়। বিদেশে চেষ্টা-চরিত্র করে ওই জন্যেই গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। মন্ত্রীর দলে গেলে কাস্টমস বেশি কড়াকড়ি করবে না, ভেবেছিলেন। এদিকে ভারতবাবু ওঁর বিরোধীদলের বিরাট ঘাঁটি বলতে পারেন!
হ্যাঁ–সে তো সবাই জানে এখানে।
পানিগ্রাহী জনৈক মহিলাকে প্যাকেটটা ভারতবাবুর হোটেলে সুবিধেমতো জায়গায় পাচার করতে নিযুক্ত করেছিলেন সম্ভবত। হা–এখনও সবই অনুমান। তাই সুইট নম্বর এতে কোনও মহিলা ছিলেন বা এখনও আছেন কি না এখনই জানা দরকার।
সুইট নম্বর এ? আলিকে বলা আছে আমাদের তদন্ত শেষ না হওয়া অব্দি কাকেও চেক আউট করতে দেবে না। যদি সকাল সাতটার মধ্যে কেউ গিয়ে থাকে–উপায় নেই।
সব আমার অনুমান। তাকে নিযুক্ত করার কারণ, পানিগ্রাহী মহিলাটিকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মানে মহিলাটি নিশ্চয় তাহলে তথাকথিত সোসাইটি গার্ল। পানিগ্রাহীর নির্বুদ্ধিতার মাত্রা দেখে তাক লেগে যায়। ভদ্রলোক গত ইলেকশানে হেরে গিয়েছেন তাই জেদ। অফকোর্স–দিস ইজ এ সাইকলজিকাল প্রসেস। বাজি ধরে ক্রমাগত নির্বুদ্ধিতা বাড়িয়ে চলা একটা জীবন-মরণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত ওঁর মতো লোকের পক্ষে। ক্রমশ জেদ বাড়ছে, ক্রমশ নির্বোধ হয়ে পড়ছেন, ক্রমশ পাগলের মতো সম্ভব-অসম্ভব পথে টাকা খরচ করে দেউলিয়া হবার পথে পা বাড়াচ্ছেন। হ্যাঁ–এই হচ্ছে পানিগ্রাহীর বর্তমান জীবন। ওইভাবে মিঃ শর্মাকে আনিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ভদ্রলোক কখন তন্দ্রা বা সুমন্ত খবর দেবে যে পাখি ফাঁদে পড়েছে। তখন উনি শর্মাকে লেলিয়ে দেবেন। মিঃ সেনাপতি, পানিগ্রাহী প্রচণ্ড সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ–তা আমি টের পেয়েছি। যেমন–আপনাদের অর্থাৎ লোকাল পুলিশকে উনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই আগেভাগে কিছু জানাননি। ভেবেছিলেন, শর্মার মাধ্যমে সে ব্যাপারটা সেটলড হবে।