আশা করি গুলিভরা রিভলভারই পেয়েছেন কোটের পকেটে!
ডঃ রায় ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ।
আপনার রিভলভারটা কত ক্যালিবারের?
পয়েন্ট থার্টি এইট। কোল্ট।
পরপর ছটা গুলি ছোঁড়া যায় তাহলে?
হ্যাঁ।
ছটা গুলিই পেয়েছেন?
ডঃ রায় ঠোঁট ফাঁক করে রইলেন এবার। কর্নেলের খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়েছে। বেসিনে হাত ধুয়ে এসে সামনে দাঁড়ালেন ডঃ রায়ের। ডঃ রায় ওঁর দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট বের করে আস্তে বললেন, দুটো গুলি নেই চেম্বারে।
কর্নেল বললেন, অরুণেন্দু কোথায় এখন, ডঃ রায়?
ডঃ রায় ফেটে পড়লেন এবার। ওই শুওরের বাচ্চার মতলব আমি আঁচ করেছিলুম ইদানিং ঘন-ঘন আসা এবং মোহান্তজীর আড্ডায় যাওয়া দেখে। ওঃ! শেষে আমাকেও ফাঁসিয়ে ছাড়ল! কর্নেল! বিশ্বাস করুন–আমি ভাবতেও পারিনে যে ও এতদূর এগোবে!
অরুণেন্দু কি এখনও আছে আপনারা কোয়ার্টারে?
না। তখনই কেটে পড়েছে। ওকে সামনে পেলে তো গুলি করে মারতুম।
উত্তেজিত হয়ে আর লাভ নেই, উঃ রায়! কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট বের করলেন। লাইটার জ্বেলে প্রথমে ডঃ রায়ের সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে নিজের চুরুট ধরালেন। কাল ডেড মাইন এলাকায় ৩৪৭ নং পিটের কাছে অরুণেন্দু যখন গর্তে জলকাদার ভেতর খন্তা চালাচ্ছিল, গর্তের ধারে নরম মাটিতে ওর জুতোর স্পষ্ট ছাপ পড়েছিল। ফুলঝরিয়া লেকের টিলার নিচে বালির ওপর যে জুতোর ছাপ দেখেছিলুম, তার সঙ্গে হুবহু এক। এ বয়সেও আমার স্মৃতি প্রখর, ডঃ রায়। জুতোর ছাপের মিলটা না দেখা পর্যন্ত আমার অরুণেন্দুকে সন্দেহ হয়নি, তা নয়। মোহান্তজীর সঙ্গে ওঠাবাসা করে জানার পর থেকে সন্দেহ অবশ্যই হয়েছিল। তবে জুতোর ছাপ দেখে নিঃসংশয় হয়ে বুঝলুম কে অনুরাধার খুনী।
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কর্নেল ফের বললেন, কাল বিকেলে আমরা না গিয়ে পৌঁছলে ভাবনার দশাও অনুরাধার মতো হতো। অরুণেন্দু জানত মঞ্জুশ্রীকে তার সঙ্গে ডেড মাইন এলাকায় যেতে বললেও সে যাবে না। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল ভাবনাকে ডেকে পাঠানো মঞ্জুশ্রীর মারফত। ভাবনাকে খুন করাটা ভোলা ও রামুর ওপর চাপানো সহজ ছিল।
ডঃ রায় বললেন, ভাবনাকে খুন করার উদ্দেশ্য কী?
ভাবনা তার বন্ধুর মৃত্যুতে আঘাত পেয়ে বড্ড বেশি নাক গলাতে শুরু করেছিল। আমার কাছে তার যাতায়াত, আমাকে সঙ্গে নিয়ে মোহান্তজীর কাছে যাওয়া–সবই সে লক্ষ করে থাকবে। তার চেয়ে বড় কথা, অরুণেন্দুর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, অনুরাধা ভাবনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অতএব যা জানে, তা ভাবনারও জানার কথা। তাই ভাবনাকে খুন করার জন্য একটা মিথ্যা গল্প ফেঁদেছিল। ফুলঝরিয়া লেকের টিলা থেকে ভোলা বেদীর পাথর আনতে যায়নি–আসলে অরুণেন্দুই ওটা চুরি করে ওখানে পুঁতে রেখে এসেছিল। বেগতিক দেখে সরিয়ে এনে পিট নং ৩৪৭-এ ঢুকিয়ে রেখেছিল। তার চোখের সামনে পিট নং ৩৪৭ এর ফলক। অথচ সে ন্যাকা সেজে খোঁড়াখুঁড়ির ভান করছিল। ভাগ্যিস, ভাবনা অন্য জায়গা খুঁড়তে গিয়েছিল এবং দৈবাৎ আমরা গিয়ে পড়লাম ওখানে।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ভোলা ও রামুর মুখ বন্ধ করতে আপনার রিভলভার চুরি করেছিল অরুণেন্দু। তাদের সঙ্গে তার এঁটে ওঠা অসম্ভব। কিন্তু রিভলভার পেলে আর চিন্তা থাকে না।
কিন্তু ওদের মুখ বন্ধ করার দরকার হল কেন?
বেদীটা ওদের সাহায্যেই চুরি করেছিল বলে। ওরা পুলিশের জেরার চোটে কবুল করত। সেই ভয়ে সম্ভবত ওদের পালাতে পরামর্শ দিয়েছিল এবং ট্রেনে চাপিয়ে দেবার ছুতো করে এসে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরেছিল। খাটালের একজন লোক দেখেছে অরুণেন্দু, ভোলা ও রামু একসঙ্গে রেললাইনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। পুলিশকে বলেছে সেই লোকটা।
মোহান্তজী কিছু জানতেন না?
জানলেও অক্ষম স্থবির মানুষ। ভোলা ও রামুর বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।
ডঃ রায় শ্বাস ছেড়ে বললেন, একটা কথা বুঝতে পারছি না। সুদীপ্ত খুন হবার সময় অরুণেন্দু এখানে ছিল। ওই সময় বেদীটাও চুরি যায়। বুঝতে পারছি, তার আগে সুদীপ্তের ফর্মুলাও সে হাতিয়ে নিয়েছে–
এবং ৩২৭ নং পিটে লুকিয়ে রেখেছে।
হ্যাঁ। কিন্তু ওগুলো নিয়ে চলে যায়নি কেন? কেন ও এতদিন অপেক্ষা করছিল। কলকাতা ফিরে গিয়েছিল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এল আবার ২৪ অক্টোবর বিকেলে।
কর্নেল হাসলেন। খদ্দের ঠিক করতে গিয়েছি। তাছাড়া আর কোনও কারণ থাকতে পারে না। কোনও বিদেশী রাষ্ট্রের এজেন্ট ঠিক করে সে আবার এসেছিল। যাই হোক, এজেন্ট ভদ্রলোক বেগতিক দেখে আজ বিকেলের ট্রেনে কেটে পড়েছেন।
ডঃ রায় চমকে উঠলেন। বলেন কি? পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল না কেন?
প্রমাণ করা যাবে না কিছু। কর্নেল জোরালো হেসে বললেন। আমার পাশের ঘরেই ছিলেন ভদ্রলোক।
বিদেশী?
মোটেও না এসব ক্ষেত্রে অত বোকামি করা হয় না।
আলাপ হয়েছিল আপনার সঙ্গে?
না। আলাপের সুযোগ পেলুম কই?
আবার গাড়ির গরগর শব্দ হল বাইরে। তারপর পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা এলেন হাসিমুখে। ডঃ রায়কে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। কর্নেল পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই শৰ্মাজী বললেন, ডঃ রায়কে আমি চিনি। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ডঃ রায়ের ভাগ্নে অরুণেন্দুকে একটু আগে আমরা রেলস্টেশনে গ্রেফতার করেছি।