সে খিলখিল করে হেসে উঠল। মিঃ শর্মা এদিক ওদিক ঘুরে কী দেখছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে। এটাই তো দেখছি পিট নম্বর ৩৪৭। ওই তো ঢিবির তলায় কাঠের ফলকে লেখা আছে।
ফলকের ওপর ঘাস হাত বাড়িয়ে আছে। তবু পড়া যায়। অরুণেন্দু বলল, ফলকটা চোখে পড়েনি আমার। তবে অনুমান করেছিলুম এটাই ৩৪৭ নম্বর পিট।
কর্নেল গর্তটা ঘুরে ঢিবির নিচে ফলকটার কাছে গেলেন। তারপর জায়গাটা পরীক্ষা করে বললেন, কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে সিল করা ছিল বটে কিন্তু স্ল্যাবটা উপড়েছিল মনে হচ্ছে। মিঃ শর্মা, আসুন তো। খন্তা দিয়ে স্ল্যাবটা ওপড়ানো যায় নাকি দেখি। ওপরের দিকটায় সূক্ষ্ম ফাটল দেখতে পাচ্ছি।
কনস্টেবল দুজন রাইফেল রেখে এগিয়ে গেল মিঃ শর্মার নির্দেশে। দুজনে খস্তাদুটো দিয়ে চাড় দিতেই বিরাট কংক্রিটের চাবড়া সরে কাত হয়ে পড়ল। ভেতড়ে সুড়ঙ্গের মতো প্রকাণ্ড হ। কর্নেল কিটব্যাগ থেকে টর্চ বের করে ঝুঁকে গেলেন সুড়ঙ্গের ভেতরে। তারপর টর্চ জ্বেলে বললেন, হু লালকাপড় বাঁধা জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি। আরও একটা কী দেখা যাচ্ছে যেন।
কর্নেল গুঁড়ি মেরে ভেতরে ঢুকে গেলেন। একটু পরে সুড়ঙ্গের মুখে ফিরে এসে বললেন, মিঃ শর্মা। ধরুন।
প্রথমে লালকাপড়ে বাঁধা জিনিসটা, তারপর একটা ব্রিফকেস–পুরনো, ইষৎ তোবড়ানো।
কর্নেল বেরিয়ে এলেন। লালকাপড়ের গিঁট খুললে বেরিয়ে পড়ল কাদামাখা একটা কালো চৌকো পাথর–অত্যন্ত হাল্কা ওজন। আন্দাজ আটইঞ্চি চওড়া এবং চার ইঞ্চি মতো পুরু। পার্বতীমন্দিরের চুরি যাওয়া সেই উল্কাপাথরের বেদীটাই বটে।
ব্রিফকেসটা অনেক চেষ্টায় খোলা হল। তার ভেতর প্যাকেট করা একগাদা কাগজ–দুর্বোধ্য সব আঁকজোক, নকশা, অঙ্ক, জ্যামিতি। একটা মোড়ক থেকে বেরুলো কয়েক টুকরো কালো অসম্ভব হাল্কা চাকতির মতো জিনিস। অরুণেন্দু ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছিল উত্তেজনায়। বলল, এসব কী?
কর্নেল বললেন, দীপ্তেন্দু মিত্রের ব্রিফকেস। সম্ভবত তার আবিষ্কৃত সেই আশ্চর্য মিশ্র ধাতুর ফর্মুলা আর নমুনা আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এই ব্রিফকেসটা চুরি গিয়েছিল তার ল্যাবরেটরি থেকে।
মিঃ শর্মা বললেন, আর এখানে নয়। এখনই মোহান্তজীকে গ্রেফতার করতে হবে।…
.
০৭.
পরদিন সকালে পুলিশ ইন্সপেক্টর শর্মাজী এলেন সেচবাংলোয়। কর্নেল তখন ছিপ আর প্রজাপতি ধরা জাল নিয়ে বেরোবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। বললেন, কী মিঃ শর্মা? আসামী কবুল করল কিছু।
শৰ্মাজী বললেন, মোহান্তজী ভীষণ ধূর্ত লোক। পেট থেকে কথা আদায় করা গেল না। তার ওপর প্রভাবশালী মহল থেকে ভীষণ চাপ শুরু হয়েছে। ওঁকে ছেড়ে দিতে হবে বলে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
ভোলা আর রামুকে পাওয়া যায়নি এখনও?
নাঃ। বেমালুম গা ঢেকে দিয়েছে। শৰ্মাজী হতাশভঙ্গিতে বললেন, তবে মোহান্তজীর পেছনের লোকটি কে, সেটা যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে, ততক্ষণ কালোপাথর ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। বেদীর পাথরটা আর বিজ্ঞানী দীপ্তেন্দু। মিত্রের উদ্ভাবিত মিশ্র ধাতু–যার কোড নেম দিয়েছিলেন ব্ল্যাকস্টোন–উভয়ের মধ্যে সম্পর্কটা বোঝা যাচ্ছে না।
কর্নেল একটু হাসলেন। বোঝা গেছে খানিকটা। কাল রাত্রে দীপ্তেন্দুবাবুর ব্রিফকেসের গবেষণাপত্র ওল্টাচ্ছিলুম। আমি বিজ্ঞানী নই ঠিকই, কিন্তু প্রাথমিক কতকগুলো ব্যাপার আমার জানা আছে। পল্লবগ্রাহিতা বলতে পারেন।
বিলক্ষণ জানি। আপনি সর্বশাস্ত্রবিদ, পণ্ডিত মানুষ!
কর্নেল হো হো করে হেসে ফেললেন। দেখুন মিঃ শর্মা। পণ্ডিত এবং শিং ওয়ালা প্রাণীর কাছ থেকে আমি সব সময় একশো হাত দূরে থাকি। যাইহোক, দীপ্তেন্দুবাবুর নোটগুলোতে দেখছিলুম, একখানে মন্তব্য লেখা আছে : এক ধরনের কালো উল্কাপাথর পাওয়া গেছে বহু জায়গায়। বারাহিয়ার পার্বতীমন্দিরের ভেতর একটা বেদী আছে। সেটাও ওই শ্রেণীর পাথর। এ আসলে পাথরই নয়। একজাতের। মিশ্র ধাতু। খুব হাল্কা এবং শক্তিশালী।.কর্নেল উঠে গিয়ে ব্রিফকেসটা নিয়ে এলেন। এটা আর কাছে রাখা নিরাপদ নয়। আমার পরীক্ষা শেষ। আপনি নিয়ে যান এবার। তাছাড়া এটা কোর্ট এভিডেন্স।
শৰ্মাজী ব্রিফকেসটা নিয়ে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কার হল না কর্নেল!
বেদীর পাথরটা দেখেই দীপ্তেন্দু মৈত্র ওইরকম ধাতু কৃত্রিম উপায়ে তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এটুকু অনুমান করতে পেরেছি। এবার বুঝতে আশা করি অসুবিধে হবে না মিঃ শর্মা, যিনি দীপ্তেন্দুবাবুর এই ব্রিফকেস চুরি, তাকে হত্যা এবং পরে অনুরাধাকে হত্যা–এতসব কাণ্ড করিয়েছেন, তাঁরই ওই বেদীটা হাতানোর চেষ্টা করা স্বাভাবিক। মোহান্তজীর পেছনের যে লোকটির কথা আপনি বলছিলেন, তিনি মূল অপরাধী। মেহান্তজী টাকার লোভে চেলাদের সাহায্যে তাঁরই হুকুম তামিল করেছেন।
মোহান্তজীকে কবুল করানো প্রায় অসম্ভব কর্নেল।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে দীপ্তেন্দু যেভাবে হোক, টের পেয়েছিল তার ব্রিফকেস চুরি করে ডেড মাইনের ৩৪৭ নং পিটে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। হা–মোহান্তজীই লুকিয়ে রেখেছিলেন ভোলা ও রামুর সাহায্যে। নিশ্চয় দরাদরি চলছিল। তাই ওই ব্যবস্থা।
বেশি টাকা চেয়েছিলেন হয়তো।
তাই মনে হচ্ছে। তবে একজায়গায় ব্রিফকেস, অন্য জায়গায় বেদীর পাথর লুকিয়ে রাখার অতিরিক্ত সতর্কতা। দীপ্তেন্দুবাবু রাত্রে পিট নং ৩৪৭-এ ব্রিফকেস উদ্ধার করতে গিয়ে খুন হলেন। তার আগে ব্যাপারটা তার প্রেমিকা অনুরাধাকে বলে থাকবেন। তা না হলে অনুরাধা জানবে কেমন করে?