ফকিরদের সম্পর্কে প্রকৃত আঞ্চলিক অনুসন্ধান সবে শুরু হয়েছে। আজকালকার নানা ধরনের লোকায়ত গানের আসরে আর মেলায় কিছু কিছু ফকিরি গান শোনা যাচ্ছে। গড়ে উঠছে ফকিরি গানের গায়কবাদক। তাদের কখনও বিদেশে নিয়ে যাবার কথা ভাবা হয়নি, কারণ তাদের গ্ল্যামার নেই। প্রধানত ভিক্ষাজীবী কিছু ফকিরকে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, গায়কহিসাবে তাদের মান খুব উঁচু নয়। আসরে সাধারণত তারা লালনের গান গায়, কিন্তু তাত্ত্বিক অর্থে ও গায়নরীতিতে লালনগীতি প্রধানত বাউল ঐতিহ্যবাহী, তাই ফকিরি গানের নামে লালনের গান শোনানো বেশ স্ববিরোধী। অথচ রাঢ়বাংলায় বেশ কিছু উচ্চস্তরের ফকির আছেন এবং মৌলিক ভাবনার ফকিরি গান দুষ্প্রাপ্য নয়। সে সব গানের সংগ্রহ কাজ কয়েক বছর হল চলছে। এ ভাবেই পাওয়া গেছে কবু শা-র গান, মহম্মদ শা-র গান এবং দায়েম শা-র গান— তিনজনেই বীরভূম জেলার। সে জেলার পাথরচাপুড়ির দাতা বাবার মেলায় বাংলার বহুরকম ফকির আসেন, গানের আসর বসে। মুর্শিদাবাদ আর নদিয়াতে বেশ ক’জন ফকিরি গানের গায়ক রয়েছেন। ঘুড়িষা-ইসাপুরের গোলাম শাহ গায়করূপে খুব জনপ্রিয়। তিনি নিজেই কবুল করেছেন মাসে কুড়ি-পঁচিশটা প্রোগ্রাম করেন, হাজার পাঁচেক টাকা মাসিক রোজগার— তাতে খুব ভালই চলে যায়। তবে সকল গায়কের এমন সচ্ছলতা নেই। আজকাল মহিলা মুসলিম গায়িকারাও ফকিরি গানে চলে আসছেন পেশাদারি চালে। ফকিরি সাধনা মূলত ভাবের সাধনা, তাতে জপধ্যান জিকিরের কাজ, দমের ক্রিয়াকরণ প্রধান। প্রকৃত ফকিররা তেমন ভ্রমণশীল নন, যে-যার ডেরাতেই ডুবে থাকেন নিবিষ্ট হয়ে। দু’-একজন সাজানো ফকির গায়ক দেখেছি, বিশেষত বর্ধমান জেলায়। পরনে ঝকমকে সিল্কের চুস্ত্ ও শেরওয়ানি, ভেলভেটের জ্যাকেট, মাথায় জরির-কাজ করা বাঁকানো তাজ। গানে অবশ্য কোনও গভীরতা নেই।
বাউল বলতে ‘বীরভূমের বাউল’ শব্দবন্ধটি কিংবদন্তির মতো প্রসিদ্ধ। এই প্রসিদ্ধির একটা বড় কারণ স্থান-মাহাত্ম্য— একদিকে জয়দেব-কেঁদুলির মেলা, আরেকদিকে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা। আরেকটি কারণ ব্যক্তিমাহাত্ম্য— যার মলে নবনীদাস আর তার প্রখ্যাত পুত্র পূর্ণদাস। জয়দেবের পৌষ সংক্রান্তির মেলা, অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়, সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরের মেলা, যেখানে বহুকাল ধরে বহু বাউল সাধক ও গায়ক সম্প্রদায় আসছেন। এখানে বাউলের আসরে গান শোনেননি এমন মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব কম। এমনকী কলকাতা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে প্রচুর বাউল রসিক ও ছাত্রছাত্রী জয়দেবে যান— লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, বাস্তুকার, অধ্যাপক ও সাংবাদিকদের পক্ষে কেঁদুলি বাৎসরিক মুখবদলের পীঠস্থান। অবাধ গঞ্জিকাসেবন এবং গানের আসরের আকর্ষণ অনেককে টানে ঠিকই কিন্তু খাঁটি বাউল গানের এ এক নির্ভরযোগ্য সত্র। সাহেব-মেমদের মেলায় ইতিউতি দেখা যায়। মধ্যরাতে বাউলের সঙ্গে নৃত্যরতা ঊর্ধ্ববাহু বিদেশিনী দৃশ্যহিসাবে অভিনব সন্দেহ কী! কিন্তু তবু বলবার কথা থাকে কিছু। মনোহরদাস, ত্রিভঙ্গ খ্যাপা, নিতাই খ্যাপা, রাধেশ্যাম থেকে এমন কোন বাউল বা প্রসিদ্ধ সাধক ছিলেন যাঁরা কেঁদুলি আসেননি! নবনীদাস বাউলও এখানে আসতেন। বহুদিন এখানে থেকে প্রয়াত হয়েছেন সুধীরবাবা। এখনও স্থায়ীভাবে থাকেন অনেকে। কেঁদুলির সুনাম এতটাই পরিব্যাপ্ত যে, সারা ভারতের বহুতর উপাসক সম্প্রদায়ের সাধক এখানে এসে ধন্য হন। বাংলার বাউলের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠাভূমি হিসাবে কেঁদুলি সবচেয়ে সজীব কেন্দ্র। ঘটনাচক্রে রবীন্দ্র পরিমণ্ডল ও শান্তিনিকেতন কেঁদুলির অনতিদূরে। প্রসিদ্ধির সেটাও একটা উৎস।
রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত কখনও জয়দেব-কেঁদুলি যাননি, কিন্তু ক্ষিতিমোহন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর ও শান্তিদেব ছিলেন বহুবারের যাত্রী। সেকালে বাস ছিল না, তাঁরা গোরুর গাড়িতে যেতেন। বীরভূমের বাউলদের প্রসিদ্ধি অর্জনে রবীন্দ্র পরিকরদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বড় ভূমিকা নিয়েছে। বরাবরই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে বাউলৱা হন স্বাগত। সেই নবনীদাসের আমল থেকে শান্তিনিকেতনের গুণী আশ্রমিকবৃন্দ আর গুণগ্রাহী ছাত্রছাত্রীরা বাউলদের পরিপোষণ করেছেন। কলাভবনের অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা এঁকেছেন প্রচুর বাউল প্রতিকৃতি। বাংলার বাউলদের আজকের যে-প্রবল জনাদর তার মূলে অনেক কারণ আছে— অন্যতম একটি কারণ বঙ্গীয় শিল্পীদের আঁকা গত আট দশকব্যাপী বাউল চিত্রকলা। নন্দলাল, রামকিঙ্কর, সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর খাস্তগীর, সোমনাথ হোর থেকে কলাভবনের নবীনতম শিল্পী এঁকে চলেছেন বাউলের স্কেচ ও পোর্ট্রেট। কলাভবনের ছাত্র বীরভূমের প্যাটেলনগরের পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় সারাজীবন ধরে শত শত বাউল চিত্র এঁকেছেন, যাতে বাউলজীবনের বিচিত্র রূপাবলি ধরা আছে। আকাশের দিকে একতারা তুলে ধরে বিচিত্ৰবেশী নৃত্যপর ভাবোন্মাদ এই গায়ক সম্প্রদায় আমাদের রূপের তাপসদের কতটা উদ্বেল করেছে তার বিন্যস্ত দৃশ্যকল্প বিশ্বভারতীকেন্দ্রিক শিল্পীদের চিত্র রচনায় পাওয়া যায়। বঙ্গ সংস্কৃতিতে ও বাংলাগানে বাউলদের চিরকালীন অবদানের মতো শিল্পীদের আঁকা বাউল চিত্রাবলিও আমাদের ভিসুয়াল ঈসথেটিকসের গৌরবময় অর্জন।