আরেকটা সমস্যা এই যে, ‘বাউল’ কথাটা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক Generic সংজ্ঞা। সবাই আসতে চাইছে বা বিবেচিত হচ্ছে বাউল বলে। যথার্থ বাউল কে, কী তার জীবনাচরণ, তার করণকারণ, কী তার অঙ্গবাস, সে সব কে নির্ণয় করছে? একটু ঘনিষ্ঠ বিচারে হয়তো দেখা যাবে কেউ কর্তাভজা, কেউ পাটুলি স্রোতের সহজিয়া, কেউ জাতবৈষ্ণব, কেউ সাহেবধনী, কেউ মতুয়াপন্থী, কেউ যোগী— কিন্তু সকলেই ঢুকে গেছে বাউলের সর্বজনীন পরিচয়ের গৌরবে— কারণ বাউলদের গ্রহণীয়তা সমাজে আজকাল খুব ব্যাপক। কুষ্টিয়া অঞ্চলের ফকিররা সাদা আলখাল্লা ও তহবন্দ পরে, বাবরি রাখে, কিন্তু নিজেদের বলে বাউল। আবার পশ্চিমবঙ্গের ঝুঁটি বাঁধা গেরুয়াধারীরাও বাউল। শক্তিনাথ ঝা একটু রসান দিয়ে জানিয়েছেন:
শান্তিনিকেতনকেন্দ্রিক বীরভূমে ভদ্রলোক এবং বিদেশীদের কাছে বাউল খুব আকর্ষণীয় ও সম্মানীয় বলে বিবেচিত হয়। তাই এ অঞ্চলে চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ, অধ্যাপক, শিক্ষক বহুজন বাউল বলে পরিচয় দিয়ে বিদেশী এবং ভদ্রলোকদের চোখে পড়তে চায়। এখানে বাউল হিন্দু এবং বিশিষ্ট সাজে সজ্জিত। মুসলমান গায়কেরা এখানে ফকির।…আর এ অঞ্চলের জাত-বৈষ্ণব গায়কদের ধারণা যে তারাই যথার্থ বাউল। অন্যেরা অন্যায়ভাবে বাউল সাজছে।
তাঁর পরিবেশিত আরেকটা সংবাদ বেশ মজার। লিখছেন,
জনৈক ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত বোলপুরের গায়ক জার্মানীতে গান করতে গেলে, সুরীপাড়ানিবাসী বিশ্বনাথ দাসের পুত্র গায়ক আনন্দ দাস মন্তব্য করেন, ‘আমরা তিন চার পুরুষ ধরে আসল বাউল, ওরা হালের সাজা বাউল।’
সাজা বাউল এবং শিক্ষিত শ্রেণির রচিত বাউল গান বাংলায় অবশ্য বহুকাল ধরে আছে। লালনের মতো যথার্থ বাউল যখন জীবিত ছিলেন তখনই কাঙাল হরিনাথ ফিকিরচাঁদি ঢঙে বাউল গান লিখে এক বিশেষ সাংগীতিক মোড়কে সেগুলি সাজিয়ে গাইতেন এবং দল বেঁধে গেয়ে বেড়াতেন বহু জায়গায়। সেই ঐতিহ্য এখনও আছে। বাউল সাধনা করেন না, গানেও তত্ত্ব নেই, অথচ হালকা চালের অনেক গান লিখে বেশ নাম করেছেন এমন অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বাউল গান আমার সংগ্রহে আছে।
কিন্তু এটাও বিশেষভাবে লক্ষ করবার বিষয় যে, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে জেলাওয়ারি সমীক্ষা করলে মোটামুটি কয়েকটি অঞ্চলে বাউলদের স্বাভাবিক বংশানুক্রমিক হালহদিশ মেলে— কোনও কোনও জেলায় বাউল পাওয়া দুর্লভ। যেমন জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, দিনাজপুরের অনেকটা। হাওড়া, দক্ষিণবঙ্গ, হুগলি ও উত্তর চব্বিশ পরগনায় বাউল সাধক প্রায় নেই, কিছু পেশাদার গায়কের সন্ধান মেলে। মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ায় যাকে বলে বাউল ঐতিহ্য বা পরম্পরাগত শ্রেণি, তা নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু সাধক বা গায়ক রয়েছেন। তবে বাউল সম্মেলনে বা সরকারি বদান্যতার গন্ধ পেলে অনেকে এসে পড়েন। জেলা তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরে নিজের নাম পঞ্জিভুক্ত করবার ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহ ও সক্রিয়তা দর্শনীয়। পেশাদার ঝুমুরশিল্পী আমাকে বাউল বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হননি। মেদিনীপুরের একজন গণসংগীতশিল্পী তাঁর লেখা বাউল গান আমাকে পাঠিয়েছেন। সে গানগুলি তিনি গেয়ে থাকেন। শ্রোতারাও তারিফ করেন।
বাউল গানের অনুসন্ধানে গিয়ে পুরুলিয়ায় ‘সাধুগান’ নামের একরকম গান পেয়েছি যা ভাবের দিক থেকে শান্তরসাশ্রিত ও নির্বেদমূলক। বাউলগানের কোনও কোনও পর্যায়ের সঙ্গে সাধুগানের বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। দেহতত্ত্ব, সহজসাধনা ও বৈরাগ্য—বাউল গানের এমনতর বিষয়গুলি সাধুগানের উপজীব্য। আসলে বাউল ফকিরদের গানের সীমানা নির্ধারণ কোনওভাবেই প্রশাসনিক জেলাসীমার নিরিখে করা যায় না। বরং অঞ্চল নির্ধারণ সহজতর। যেমন ধরা যাক রাঢ়বঙ্গ। বীরভূম-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ ঘিরে প্রসারিত বাউলদের সবচেয়ে সম্পন্ন অঞ্চল, ফকিরদেরও। পশ্চিম সীমান্ত রাঢ়ের বাঁকুড়া জেলার বহু অঞ্চল বাউলদের বসবাসে সমৃদ্ধ, কিন্তু এ অঞ্চলে আচরণবাদী বা গায়ক ফকির প্রায় নেই। নদিয়া-কুষ্টিয়া-পাবনা-যশোহরে বহুদিনের ঐতিহ্যগত এক বাউলফকির পরম্পরা ছিল, আজও আছে। মুর্শিদাবাদ আর নদিয়ার গ্রামাঞ্চলে হিন্দুমুসলমান সমাজসাম্য বিস্ময়কর রকম সজীব। সরেজমিন সমীক্ষায় দেখা যায়, এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভাবের লেনদেন খুব বেশি— বাউল ও ফকিরের মর্মমিলন উদাহরণীয়। গানরচনার সজীব ধারা এখানে এখনও বহমান, অতীতদিনের বহু বিখ্যাত গীতিকারও এই ভূমিখণ্ডের সন্তান। সাধক বাউল ও ফকির এখনও নদিয়া-মুর্শিদাবাদে সবচেয়ে বেশি। গায়কদের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞদের সংখ্যা এ অঞ্চলে লক্ষণীয়। নদিয়া জেলার ক্ষেত্রে আলাদাভাবে দেখা যাবে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত কিছু মানুষ বাউলবিশ্বাসেও স্পন্দিত। তাঁদের গানে অন্য এক সমাজ-সত্যের চেহারা ফুটে ওঠে— জেগে ওঠে উদার ও অনাবিল গ্রাম্য লোকায়তের স্বস্তিকর প্রতিবেশ। মুর্শিদাবাদেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাউলফকির আছেন এবং তাঁদের অস্তিত্বের সংকট সবচেয়ে তীব্র। প্রধানত জনবিন্যাসের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে এ-অঞ্চলের মারফতি ফকিরদের তিন দশক ধরে নির্যাতিত হতে হচ্ছে মৌলবাদীদের হৃদয়হীন অনুশাসনে। নদিয়া বা বীরভূমেও মৌলবাদীদের চাপা অসন্তোষ আছে কিন্তু জনবিন্যাসের কারণেই সম্ভবত তার উৎকট প্রকাশ নেই। উত্তরবঙ্গের চিত্র এ সবের তুলনায় অনেকটা অন্যরকম। মালদহ জেলায় বাউলদের সন্ধান মিলেছে তবে উল্লেখযোগ্য নয়। উত্তরবঙ্গের ব্যাপক জনপদে দেশবিভাগের আগে বাউল ফকিরদের যে চলমানতা ছিল তা এখন বহুলাংশে ক্ষীণ। পাবনা-রংপুর-দিনাজপুর ঘিরে প্রধানত লালনপন্থীদের ব্যাপক বসবাস ছিল। দেশবিভাগের অমোঘ আঘাতে সেই জনপদ এখন বিপন্ন ও বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বাস্তুহারা বেশ কিছু সাধক ও গায়ক এ পারে চলে এসে প্রথম কিছুদিন নীরব ও বিভ্রান্ত ছিলেন। দিনাজপুর, রায়গঞ্জ, কোচবিহার প্রভৃতি অঞ্চলে এ বর্গের গান ও গায়কসমাজ কোনওদিন ছিল না, ফলে গড়ে উঠেনি বাউল গানের মরমি শ্রোতৃসমাজ। তারপর গত দুই দশকের নিরন্তর প্রয়াসে এখন উত্তরবঙ্গেও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর গীতিকার ও গায়ক এবং সারারাত ধরে গান শোনার বিপুল শ্রোতার সমাবেশ। লক্ষ করা যায়, উত্তরবঙ্গের বাউলবর্গের গান মূলত বিচারমূলক তত্ত্বগর্ভ। হালকা গান বা বাজনা-গানের শিল্পী সেখানে দুর্লভ। চটকদারি পরিবেশনরীতি বা উৎকট বেশবাস সেখানে প্রচলিত নেই। গানের পরিবেশ অনেকটা শুদ্ধ ও শান্ত, ভক্তিনম্র। বাউলদের মধ্যে মঞ্চে ওঠার বা বিদেশযাত্রার তেমন কোনও ত্বরা নেই, সুযোগও নেই, তাই নিজেদের মধ্যে লড়াই কম। প্রত্যন্ত জেলাবাসী উপেক্ষিত উত্তরবঙ্গব্যাপী বাউলদের ব্যাপারে এ-দিককার মধ্যবিত্ত গবেষক ও পত্রপত্রিকার উৎসাহ কই? তাঁদের সম্পর্কে তাই কোনও প্রতিবেদন পাওয়া কঠিন।