এখনকার গবেষকদের মধ্যে যাঁরা বাউল ফকিরদের আখড়া বা আস্তানায় গিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে, সমাজ-অর্থনীতিগত অবস্থান বুঝতে চান, এমনকী দু’-চার দিন বসবাসও করেন তাদের দরিদ্র জীবনের শরিক হয়ে, তাঁদের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। অভিজ্ঞতার তারতম্য ঘটে বেশ বড়রকম। দুটি ব্যক্তিক উদাহরণ দিতে পারি। বীরভূমনিবাসী আদিত্য মুখোপাধ্যায় বহুদিন ধরে গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরে বাউল সঙ্গ করেছে, কেঁদুলির মেলাতেও সে সাম্বৎসরিক যাত্রী। তার ব্যক্তিগত ধারণা যে বেশ ক’জন গায়ক-বাউল (অন্তত বীরভূমের) বিদেশি-বিদেশিনীর পাল্লায় পড়ে নষ্ট ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। তাদের গানের ভাব এবং কণ্ঠ সম্পদ ম্লান হয়ে যাচ্ছে, তারা গ্রস্ত হয়ে পড়ছে শ্বেতাঙ্গিনীদের দেহগত কামনায় ও অর্থলালসায়। বিদেশ যাত্রার মোহে তারা বিবাহিতা স্ত্রীদের ত্যাগ করছে বা উপেক্ষা করছে। আদিত্য এমনতর অনেক বাউলের নামধাম জানিয়ে শেষমেষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বর্তমানের বাউলরা অবশ্য পূর্ণদাসের সম্মান ও প্রচার-প্রতিপত্তির দৌলতে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ক্রমশই বিকিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদেশের বাজারে। সাহেব-মেম এবং এদেশীয় শিক্ষিত দালালরা চিবিয়ে যেমন খাচ্ছেন বাউলের মাথাটা, তেমনি একইভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে দেউলিয়া করে ছাড়ছেন বিদেশের চোখে। গরীব বাউলদের বা গায়কদের দোষ দেব না ততখানি। কারণ ক্ষুধার্তের কাছে ভাতের থালা অনেক মূল্যবান। সুতরাং বাউল হলেও যে মানুষ, তার গাড়ি-বাড়ির লালসা থাকতে দোষ কোথায়?
আদিত্য-র বাউল সমীক্ষার দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধতা করে গবেষক শক্তিনাথ ঝা বলেছেন সম্পূর্ণ উলটো কথা। তাঁর অভিজ্ঞতা ও অবলোকনও উপেক্ষা করা যায় না। তাঁর ধারণা:
বাউলদের জীবনযাপন প্রণালী, মানুষকে আপন করার পদ্ধতি, বাদ্যযন্ত্রগুলি, বেশ, গানের তাল ও পরিবেশন রীতি বিশিষ্ট। এগুলি এক শ্রেণীর বিদেশী শিল্পী ও গবেষকদের আকর্ষণ করে। দরিদ্র বিদেশী পর্যটকরা রাঢ়ের বাউলদের ঘরে অল্প টাকায় থাকে এবং প্রতিদানে নিজেদের দেশে বাউলদের আশ্রয় ও সামান্য উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়। বাউলদের গানবাজনা শেখেন অনেকে। এগুলি আত্মীকরণ করেন অনেকে। (নীরবতার) এক লোকনাট্যের সন্ধান পান বাউলদের মধ্যে অনেকে।… ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার প্রতীক হিসাবে ওরিয়েন্টালিজমের সূত্রেও এক শ্রেণীর নারী ও পুরুষ বাউলদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন।
এবারে শোনা যেতে পারে লিয়াকত আলির অভিজ্ঞতা। সে যে শুধু সন্ধানী বিদেশিনীদের সঙ্গ করেছে তাই নয়, হয়েছে তাদের ভ্রমণসঙ্গী ও বন্ধু। বাউল অনুরাগী বহু বিদেশি যুবতী ও যুবককে সে জানে। তার ভাষ্য হল:
সিরিয়া কায়ারমা মেয়েটি কবি। ভীড় হট্টগোল গান বাজনায় সে উজ্জ্বল অংশ নেয়। সময়ে আবার একেবারে নির্জনে থাকে। বিশ্বনাথ দাস বাউলের বাড়ি তার বন্ধুদের স্থায়ী ঠিকানা। সে ওখানে থাকলেও আবার শুধু আলাদাভাবে একা থাকার জন্য শান্তিনিকেতনে নিয়েছে এক ভাড়াঘর।…বাউলরাও এর ঘরটার কথা জেনে গেছিল। ফলে কেউ না কেউ এসে যেত। চলত গানবাজনা ও ফুর্তি।
সিরিয়া কায়ারমার বিবরণ পড়লে অবশ্য তাকে কোনওভাবে শক্তিনাথ ঝা-কথিত ‘দরিদ্র বিদেশী পর্যটক’ পর্যায়ে ফেলা যায় না। তার অর্থবিত্ত এতটাই যে লিয়াকতকে নিয়ে প্রয়াগ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দিল্লি, আগ্রা, ঘুরিয়ে আজমীর শরীফ গেছে। সর্বত্র থেকেছে হোটেলে। লিয়াকত বুঝতে পারে:
সবাই শুধু শুধু ঘুরতে আসে না। যেমন জনির সেক্সোফোনে বাউল গানের সুর বাজানো শিখে নিতে আসা। পিটারও এসেছিল একই উদ্দেশ্যে বেহালা নিয়ে।… বাউলের গুপ্ত সাধনার প্রতি বিদেশিনীদের সেরকম আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। যদি থাকত তবে তারা বাউল গায়কদের পিছু পিছু না ঘুরে সেই গোপন ক্রিয়া জানে বলে যারা খ্যাত সেই বাউল সাধুদের সঙ্গে ঘুরত। কিন্তু কার্যত কোন বিদেশিকেই কোন সাধুকে আশ্রয় করে ঘুরতে বা থাকতে দেখিনি। আসলে তারা গুহ্য সাধনা নয়, গায়ক বাউলদের গান ভাব নৃত্য ও আনন্দমত্ততাকেই ভালবেসেছে। তবে রুচি ও প্রকৃতি অনুযায়ী— এক এক বিদেশিনী এক এক বাউলকে বেছে নেয় মাত্র।
আদিত্য, শক্তিনাথ আর লিয়াকত তিনজনই দক্ষ সংগ্রাহক ও বাউলপ্রেমী— অভিজ্ঞতাও ঈর্ষাজনক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালের অর্থাৎ গত কয়েক দশকের বাউল ও বিদেশিনীর প্রসঙ্গ তাঁরা একেকভাবে দেখেছেন। এখনকার বাউল-ফকিরদের নিয়ে তথ্যভিত্তিক সরেজমিন অনুসন্ধানের এটি এমন সংকট যা কখনও প্রাক্তন গবেষকদের ভোগ করতে হয়নি। তার প্রধান কারণ, তাঁদের কালে এত রকম এবং এত বিচিত্র চরিত্রের সন্ধানী ছিলেন না। অভিজ্ঞতার বলয়ও নানা জেলায় বিস্তৃত ছিল না। এখন সারাবছরে বহুরকম মেলা, মচ্ছব, দিবসী বা সাধুগুরু সেবার অনুষ্ঠান হয়। তার হদিশ এবং বহুক্ষেত্রে নিমন্ত্রণ এসে যায় আমাদের কাছে। বাউল ফকিররাই তার হদিশ দেয়। এইভাবে হয়তো সোনামুখি থেকে খয়েরবুনি, সেখান থেকে নবাসন, আমরা একেক আখড়ায় সাধুসঙ্গের উৎসবে হাজির হই। ফাল্গুনে ঘোষপাড়া, চৈত্রে অগ্রদ্বীপ, শেষচৈত্রে পাথরচাপুড়ি, জ্যৈষ্ঠে আড়ংঘাটা এই ক্রমে এসে যায় বাৎসরিক মেলা ও সেই সুবাদে একত্রে থেকে বাউল ফকিরদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা একে একে খুলে ফেলে তাদের নিষেধের বেড়া। নিশীথের নিভৃতে বলতে থাকে নিজেদের কথা, নানা নারীসঙ্গিনীর সঙ্গে সাধনার কথা, এমনকী দুঃখ দারিদ্র্যের কথা, ব্যক্তিগত সমস্যার কথা। কেউ কেউ সংযত থাকে আত্মভাষণে, অনেকে হয়ে ওঠে গদগদভাষী। অনেক লঘুচিত্ত প্রচার-পিয়াসী যুবক বাউল, বেশ বুঝতে পারি, অনেক কথা বলে ফেলে বানিয়ে বানিয়ে। এখন আবার সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীসাধিকা, বাউল গায়িকা আর পেশাদার নানা গীতিকার। বাউল নয় যারা তারাও এখন বাউল গায়, বাউলতত্ত্ব আওড়ায়।