তাঁর পরবর্তী কালের সন্ধানীদের বীক্ষায় বাউল চর্চা কঠিনতর হয়ে পড়েছে—অর্থাৎ রবীন্দ্রপরবর্তী অনুসন্ধানীদের পক্ষে বাউল গান কোনও ভাবময় উচ্ছ্বাসমাত্র নয়। অনেকটাই তা যাপনগত বাস্তব আর মুক্তমনের নর-নারীর যুগল সাধনাজাত অনুভবের স্ফুরণে ইহবাদী। এ গানে আছে আচরণগত বিশ্বাসের সত্য, যা পরিপার্শ্বের প্রতিকূলতায় টলে না বরং উচ্চবর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে পারে। সেইদিক থেকে বাউল ও ফকিররা একক অথচ নিঃসঙ্গ নয়। তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে আছে প্রেমানুভূতির অস্মিতা, গুরুর বাক্যে নিষ্ঠা এবং বহুদিনের পরম্পরাজাত পথ। তাদের পথচলা সে তো আজকে নয়, সে আজকে নয়। বেদান্ত, সাংখ্য, তন্ত্র, সিদ্ধযোগী আর সহজিয়াসেবিত সমৃদ্ধ ও নিজস্ব এক লোকপথ তার সামনে মেলা রয়েছে। সেই পথকে যে খুঁজে পায়, তাকে আর সামাজিক সমুন্নতির আড়াআড়ি পথটি খুঁজতে হয় না—তার আকর্ষণ ও কুহক তাকে টানে না। সে হয়ে ওঠে সামাজিকতামুক্ত মানুষ, লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সে ‘existing order of things’-এর পরিমণ্ডল ভেঙে এগিয়ে চলে অন্তরের পাঠ নিয়ে।
আধুনিক বীক্ষায় লোকায়ত সংস্কৃতি সেইজন্য অনুধাবন করা কঠিন। সেই সংস্কৃতি প্রথমত অন্তর্গুপ্ত ও আত্মময়— কিছুটা বা অস্পষ্ট ও অপরিচিত—গ্রামে গ্রামে সুদূরবর্তী। তারা তো আমাদের কাছে আসবার প্রয়োজন বোধ করে না, তাই আমাদের যেতে হয় তাদের কাছে, সেই অভিযাত্রা আমাদেরই আত্মানুসন্ধানের স্বার্থে, শিকড়ের খোঁজে। গবেষকের তথ্যসন্ধানের চেয়ে মরমির অন্তর্দৃষ্টি তার মূল পাথেয়।
পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষিতিমোহন, মনসুরউদ্দিন, উপেন্দ্রনাথ বা অন্য সব সংগ্রাহকদের মাত্রার তফাত অনেকটা। বাউল গান হঠাৎই এসে পড়েছিল রবীন্দ্র মানসে, স্বচ্ছ দর্পণের মতো তাঁর সমুৎসুক মনে তা সঙ্গে সঙ্গে ছায়াসন্নিপাত করেছিল। তার অকৃত্রিমতা ও অন্তঃসঞ্চারী ভাবলোক তাঁর চেতনায় অনুরণন তুলেছিল, তিনি তাদের স্বপক্ষে কলম তুলে নিয়েছিলেন। চিহ্নিত করেছিলেন তাদের উচ্চারণের মৌলিকতা। কিন্তু এর পরের ধাপে তিনি যাননি। জানতে চাননি তাদের জীবন পরিবেশ, গুরূপদেশের গূঢ়তা, প্রতিবাদী সত্তার স্বরূপ কিংবা ক্ষুৎকাতর দৈনন্দিনের বার্তা। বাউল গান থেকে চুইয়েপড়া অমৃতলোকের বার্তাতে তাঁর পিপাসার্ত মন ভরেছে। তাঁর পরবর্তী সন্ধানীদের সামনের পথ কিন্তু ছিল উপলকীর্ণ। তাদের পদে পদে প্রতিহত হতে হয়েছে নানা দ্বান্দ্বিক সমস্যায়। কে বাউল, কে বৈষ্ণব, কে সহজিয়া? বাউলপস্থা আর ফকিরিপন্থার তফাত কোনখানে? এইসব মগ্ন অন্তর্দীপ্ত সাধক গানের শব্দসংকেতে যা বলেছেন তার প্রকৃত ‘text’ কী? নানা অঞ্চলে ছড়ানো ছিটোনো বাউল আর ফকিরদের মধ্যে বিশ্বাস আর গানে কি প্রচুর পার্থক্য নেই? বাউল গানের সংগীতিক ছাঁদ বা সুরকাঠামোর আঞ্চলিক পরিমণ্ডল কি বেশ আলাদা নয়? যে যৌন-যৌগিক সাধনা গুরুনির্দেশিত, সেই গুরুতে গুরুতে কতখানি ভেদ আছে, তা বুঝতে গেলে ব্যাপক পরিভ্রমণ জরুরি নয় কি? সবচেয়ে বড় কথা, এই বর্গের গান সহজপ্রাপ্য নয়। যা সহজপ্রাপ্য তাতেও কোথাও কোথাও ভেজাল আছে।
ভেজাল প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম সমাজের প্রান্তিক মানুষরূপে বাউল ফকিররা বেঁচেবর্তে থাকত মাধুকরী করে। নিজেদের আখড়ায় নিজেদের মতে সাধনভজন করত, গান গাইত। গ্রামসমাজ তাদের সমাদরও করত না, ঘৃণাও করত না। তারা কৃষিজীবী ছিল না, জমিজিরেতে তাদের কোনও আগ্রহ ছিল না। তাই কোনওরকম সংঘাত সংগ্রামে তাদের অংশ ছিল না। শান্ত, ভক্তিমান, উচ্চাশাহীন এমন মানুষদের কেই বা শত্রু হবে? কিন্তু পট পালটে গেল গত তিন দশকে। এ বর্গের রহস্যমাখানো গান হঠাৎ হয়ে উঠল ভোগ্যপণ্য, বিশেষত শহরবাসী মধ্যবিত্তদের। তারা এসব গানে খুঁজে পেল সমাজসত্যের দ্যোতনা আর উচ্চবর্গের শোষণ দমনের প্রচ্ছন্ন ইতিহাস। লালন আর দুদ্দু শাহ-র গানে, পাঞ্জু শাহ বা হাসন রজার বাণীময়তায়, রশীদ-জালাল-দীন শরৎ-যাদুবিন্দুর উচ্চারণে খুঁজে পেল মধ্যবিত্ত ভাবনার সঙ্গে সমঞ্জস নানা সারকথা। জাতপাতবিরোধী বাউল গানের টেক্সট রাজনীতিসচেতন মানুষের পক্ষে ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠল। ক্রমে এ পথেই ঢুকে গেল সদ্যতনকালের ভেজাল গীতিকার। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা লালন কিংবা অন্যের ভণিতার আড়ালে চালিয়ে দিল ব্যক্তি বা দলের ফরমান। লালনের নামে বহুপ্রচারিত এমন একটি গান এইরকম :
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
সেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।
শোনায়ে লোভের বুলি
নেবে না কাঁধের ঝুলি
ইতর আতরাফ বলি
দূরে ঠেলে না দেবে।
আমীর ফকির হয়ে একঠাঁই
সবার পাওনা খাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই
ভবে কেউ নাহি পাবে।
ধর্ম কুল গোত্র জাতির
তুলবে না গো কেহ জিগির
কেঁদে বলে লালন ফকির
কে মোরে দেখায়ে দেবে।
লালনের নামের আড়ালে কোনও আধুনিক সাম্যবাদীর স্বপ্নাদ্য রচনা এ-গান তাতে সন্দেহ নেই—উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। হিন্দুমুসলমানবৌদ্ধখ্রিস্টান সকলকে নিয়েই গানের শরীর গড়ে উঠেছে, ভাবা হয়নি যে লালনের সময়ে (আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিকালে) জাতিভাবনার এত বিস্তার ছিল না, অন্তত প্রত্যন্ত গ্রামে। মুসলমানের বর্ণভেদ প্রসঙ্গে আশরাফ-আতরাফ বিভাজন লালনের কালে পল্লিগ্রামে থাকা কি সম্ভব? আর আমির ফকির সবাই যে যার পাওনা পাবে এমন সাম্যচিন্তা তো অভিনব, তবে স্বপ্নহিসাবে সুন্দর। লালনের শত শত গান যাঁদের নাড়াচাড়া করবার সুযোগ হয়েছে তাঁরা মানবেন যে এত দুর্বল রচনাশৈলী ও এমন খেলো অন্ত্যমিল (রবে, দেবে, পাবে, দেবে) লালন-গীতির কোথাও থাকতে পারে না। সবচেয়ে কাঁচা কাজ হয়েছে ‘কেঁদে বলে লালন ফকির’ পদটি লেখা। লালন তাঁর কোনও পদে কখনও ‘লালন ফকির’ শব্দটি লেখেননি। তা ছাড়া সিরাজ সাঁইয়ের নাম নেই কেন? এত সব খুঁত বিচারের পরে আরও দুটি তথ্য বিচার্য থাকে। দুই বাংলার কোনও মান্য লালনগীতি সংকলনে এ-গানটি নেই এবং কোনও পরম্পরাগত গানের আসরে সাধক বা প্রখ্যাত গায়ক বাউল-ফকিরের কণ্ঠে গানটি কেউ শোনেননি। তা হলে?