কাজটি যখন অর্ধপথে তখন সচিব চন্দনকুমার চক্রবর্তী অন্যত্র বদলি হয়ে যান এবং সচিবের দায়িত্ব নেন লোকসংস্কৃতিমনস্ক মরমি মানুষ প্রদীপ ঘোষ। তাঁর উৎসাহ আর সহযোগিতা আমাকে বিশেষভাবে প্রেরিত করেছে। বাউল ফকিরদের জেলাওয়ারি বর্ণানুক্রমিক তালিকা প্রণয়নের কষ্টসাধ্য অথচ সতর্ক কাজটি করেছেন আমার স্ত্রী নিবেদিতা চক্রবর্তী। আলোকচিত্র বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করেছেন প্রদীপ বিশ্বাস।
বইটির বিন্যাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। এর স্পষ্টত দুটি ভাগ। প্রথম ভাগে আছে বাংলার বাউল ফকিরদের অতীত ও বর্তমানকে মিলিয়ে আমার বক্তব্য—যার তথ্যভিত্তি সরেজমিন সন্ধানজাত বাস্তব মালমশলা। এই অংশ লিখতে অনেক প্রাক্তন সূত্র বা তথ্যেরও সাহায্য নিয়েছি কিন্তু গড়পড়তা গবেষণা বইয়ের মতো পাদটীকা বা উল্লেখপঞ্জিতে কণ্টকিত করিনি। করতে চেয়েছি এক সুখপাঠ্য প্রতিবেদন এবং বিশ্লেষণবহুল উদ্ঘাটন ও অবলোকন। দ্বিতীয় ভাগে আছে একজন ফকিরের আত্মকথা, দুজন ফকিরের আত্মবিবৃতি ও আমার প্রাসঙ্গিক ভাষ্য। তারপরে আছে একজন ফকিরের পদ্যে রচিত তত্ত্বসন্দর্ভ। এগুলি অনুসন্ধানসূত্রে সংগৃহীত। তারপরে আছে তিরিশটি ফকিরি গান আর ষোলোটি বাউল গান এবং অন্ধবাউলের রচিত একটি গান। এগুলি প্রধানত মৌখিক সূত্রে সরাসরি সংগৃহীত। বইয়ের পরবর্তী অংশে আছে দশটি গানের স্বরলিপি, যার কিছু বাউল কিছু ফকিরি—উৎসাহীজনেরা এগুলি চর্চা করলে বাংলার বাউল ও ফকিরিগানের বেশ ক’টি শৈলীর আস্বাদ পাবেন। সবশেষে আছে বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো ফকিরদের তালিকা এবং জেলাওয়ারি বাউলদের তালিকা এবং সেইসঙ্গে বাউল ফকিরদের আর্থ-সামাজিক পরিচয় সারণি। এইসব তালিকা সম্পর্কে দুটি স্বীকারোক্তি মনে রাখতে হবে। এক, এই তালিকা সম্পূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত নয়—অর্থাৎ এর বাইরে আরও বেশ কিছু বাউল ফকির থাকতে পারেন। দুই, তালিকার অন্তর্ভুক্ত দু’-চারজন ব্যক্তি তালিকা প্রণয়নের পরে প্রয়াত যেমন উত্তরবঙ্গের বলহরি দাস, নবাসনের হরিপদ গোঁসাই এবং নদিয়ার ষষ্ঠী খ্যাপা। আরও কেউ কেউ হয়তো মরলোকে নেই কিন্তু সে তথ্য জানা যায়নি। তিন, এ বইয়ের যাবতীয় ব্যক্তি-তথ্য ও পরিসংখ্যান ২০০২ সালের। তার পরিমার্জন বা পরিবর্ধন এখন আর করা সম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে ‘বাউল ফকির কথা’ বইটি পশ্চিমবাংলার বাউল ফকিরদের সাম্প্রতিক অবস্থানের বিশ্বস্ত রূপরেখা উপস্থাপিত করতে প্রয়াসী। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনায় এবং গৌণধর্মীদের প্রকৃত সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নির্ণয়ে এই আগ্রহী রচনা কিছু তথ্য, তত্ত্ব ও জিজ্ঞাসা সংযোজন করতে পারলে পরিশ্রম সার্থক হবে। উজ্জ্বল হয়ে উঠবে লৌকিক সাধক ও লোকশিল্পীদের মুখশ্রী। তাঁদের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য।
সুধীর চক্রবর্তী
৮ রামচন্দ্র মুখার্জি লেন
কৃষ্ণনগর ৭৪১ ১০১
১.১ সূর্য আর শিশির
বাংলার বাউলদের নিয়ে প্রথম সদর্থক রচনা ও অনুকুল মত-মন্তব্য পাওয়া গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের লেখায়। তাঁর মন একই সঙ্গে দেশজ প্রসঙ্গ আর আন্তর্জাতিক সংরাগে সাড়া দিতে পারত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের নিজস্ব নির্মাণে তথা বন্দিশে ভারতীয় রাগ সংগীত ও প্রতীচীর গানের ধারার সঙ্গে আনুপাতিক মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন লোকগান ও দেশজ কীর্তনের। তাঁর বিশিষ্ট মনের গঠনে একাধিক উপাদান মিশেছিল। তাই বিশ্ববোধের সঙ্গে লোকায়নের সহবাস তাঁর চৈতন্যে ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানো ছিল তাঁর ঘোষিত অনুজ্ঞা, কেননা বিশ্বাস ছিল একমাত্র তাতেই বুকের মধ্যে। বিশ্বলোকের জাগবে সাড়া—অথচ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করার আততি ছিল প্রবল। সারা জীবনের যে-ধ্রুবপদ বাঁধতে চেয়েছিলেন, বিশ্বতানের ছন্দে তার মধ্যে একতারার মান্যতাও ছিল সুসংগতভাবে। তাই আপন প্রতিভার বিপুল কিরণে ভুবন আলোকিত করার পরেও তাঁর মন স্পর্শ করতে চাইত শিশিরবিন্দুর অন্তর্গত আকুতিকে। এই দিক থেকে ভাবলে স্পষ্টতর হবে তাঁর আন্তর সত্য, যা মালা হতে খসে পড়া ফুলের একটি দল-এ লগ্ন হতে চাইত কিংবা ধূলিতে অবলীন ভ্রষ্ট ফুলের ধন্যতাকে বুঝতে চাইত। সেই সত্যবোধ আমাদের জানাতে চেয়েছিল, যার জন্ম ধূলিতলে তার অন্তর হতে পারে। নিরঞ্জন অকলঙ্ক। জেনেছিলেন যেখানে থাকে সবার অধম দীনের থেকেও দীন সেইখানেই ঘটে প্রার্থিতের পদপাত।
তা হলে আশ্চর্যের কী আছে যখন দেখি নিরুপাধি অমানী বাউলদের তিনিই প্রথম শ্রদ্ধা। আর ভালবাসার সঙ্গে হাজির করলেন বিশ্বমঞ্চে? বাউলদের অন্তরতম সত্যের অনুভব তাঁকে এতটাই উদ্বেল করেছিল যে তাদের রচনা সংগ্রহ ও প্রকাশে তিনি হয়েছিলেন কুণ্ঠাহীন। ঐতিহ্যের পথে চলমান এই মুক্ত সাধকদের চর্যা আর তাঁর সত্যানুসন্ধান মিশে গিয়েছিল এক বিন্দুতে। তারপরে নানা রূপান্তরের বাঁকে রবীন্দ্রজীবন ও রচনাবলি এগিয়ে গেছে বিচিত্রগামিতার সাগর সংগমে। কিন্তু তাঁর প্রদর্শিত দিশা নিয়ে বাউলদের জীবন ও গানকে পরবর্তী প্রজন্ম যে যথাযথ মান ও মর্যাদায় সম্পূর্ণভাবে উদ্ঘাটন বা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন তা মনে হয় না।
উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণের এই অক্ষমতার কারণ কি? সবচেয়ে বড় কারণ বাউলদের সঙ্গে ‘ভদ্রলোক’দের অপরিচয় ও অবস্থানগত লক্ষযোজন ফাঁক। গ্রামিক জীবনের সঙ্গে স্বাভাবিক মুক্ত ছন্দে গাঁথা বাউল ফকিরদের স্বরূপ ও অন্তৰ্জীবন ভদ্ৰশ্রেণির নাগরিক অনুসন্ধানের সূত্রে কীভাবে সঠিক উন্মোচিত হতে পারে? তা ছাড়া তারা তো স্বভাবত ও আচরণগতভাবে সমাজে একটা সূক্ষ্ম আড়াল রচনা করতে চায়। চেষ্টিত অন্তরাল সৃষ্টি করে যুগল সাধনায় গড়ে তোলে এক রহস্যময় ও গোপ্য কায়াবিশ্ব। রবীন্দ্রনাথকে এই জায়গায় এসে আধুনিক জিজ্ঞাসুদের মতো প্রতিহত হতে হয়নি—কারণ তিনি বাউলদের নিয়ে কোনও সরেজমিন সন্ধান করেননি। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ধারায় বা সমাজ-নৃতত্ত্বের বিদ্যাচর্চার অনুক্রমে তাদের বুঝতে চাননি। তাদের প্রচ্ছন্ন গোষ্ঠীজীবন, একক অথচ সংহত সমাজ, যা একই সঙ্গে মরমি অথচ প্রতিবাদী, তাকে তিনি অনুধাবন করতে পারেননি। বাউলগানকে তাই তাঁর মনে হয়েছিল একক মানুষের আন্তরিক উচ্চারণ বলে।