এই পথে কাজ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে প্রচ্ছন্ন সমাজকে কীভাবে যেন ছুঁয়ে ফেলি। যে বাউলদের কোনও জাতি বা গোত্র থাকা উচিত নয়, আশ্চর্য যে, তাঁদের অনেকে নিজের গোত্রপরিচয় দিয়েছেন ‘আলম্বায়ন’ এবং ‘অচ্যুতানন্দ’ বলে। পূর্ব বা পুনর্জন্মে যাঁদের বিশ্বাস থাকার কথা নয়, বাস্তবে কিন্তু অনেকে তাতে রীতিমতো বিশ্বাসী। অনেকে একজনের কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছেন আর সংগীতশিক্ষা নিয়েছেন আরেকজনের কাছে। বাউল ফকিরদের গরিষ্ঠসংখ্যার কাছে প্রিয় গীতিকার লালন শাহ। অনেক বাউল আবার সক্রিয়ভাবে গণসংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ব্যক্তিগত জীবনে অমর্যাদা ও অপমানের কথা অনেকে বলেছেন, সেই সঙ্গে সাধারণ শ্রোতাদের কাছে প্রসার প্রতিষ্ঠার কথাও জানিয়েছেন। প্রশ্ন-সারণি থেকে বেশ বোঝা যায় ডুগি-একতারা বাজিয়ে নিরাভরণ কণ্ঠবাদনে এখনকার শিল্পীরা সাদামাটা গান গাইতে আর রাজি নন, নানা যন্ত্রানুষঙ্গে বেশবাসে ও চমকে তাঁরা গান পরিবেশনে তৎপর। অনেক বাউল বা ফকির অনুমিত কারণে তাঁদের মাসিক আয় কত তা জানাননি। বেশির ভাগই তাঁদের মাসিক আয়, তিনশো থেকে সাতশো টাকা বলে জানিয়েছেন৷ তা সত্যি হলে বলতে হবে আমাদের লোকশিল্পীরা দরিদ্রতম।চার ছেলে চার মেয়ে স্ত্রী ও নিজে এমন দশজনের পরিবারে গান গেয়ে উপার্জন পাঁচশো টাকা— কেমন করে তাঁরা বেঁচে আছেন?
এত নৈরাশ্যের মধ্যে আর অতলগর্ভ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেও তবু পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকির সমাজ দুর্মর জীবনপ্রত্যয়ে বলিষ্ঠ। তাই তাঁদের কণ্ঠের গান কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। দেখা গেছে মুর্শিদাবাদের কোনও কোনও গ্রামাঞ্চলে মৌলবাদীদের অত্যাচারে নিপীড়নে তাঁরা অতিষ্ঠ এবং জর্জরিত। একতারা ভেঙে, আখড়া পুড়িয়ে, দাড়িগোঁফ মুণ্ডন করে, একঘরে বানিয়েও তাঁদের মতাদর্শ আর গানের সরণি থেকে ভ্রষ্ট করা যায়নি। এখনও গান রচনা করছেন তাঁরা। আলাদাভাবে বেশ ক’জন প্রতিবন্ধী বাউলকে আমরা পেয়েছি— শরীরের প্রতিবন্ধ পেরিয়ে যাঁরা গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তেমনই আত্মবিশ্বাসী নানা বয়সের গ্রাম ও মফস্সলের নারীদের সাহচর্য আমাদের চমকে দিয়েছে যাঁরা সমাজপরিত্যক্ত কিংবা বিধবা কিন্তু বাউল গান তাঁদের জীবিকা ও জীবনের রসদ জুগিয়ে চলেছে। এমন প্রবীণ বাউল সাধক তথা গায়ককে তাঁর আশ্রমে গিয়ে আবিষ্কার করেছি, বেশ ক’বার বিদেশ ভ্রমণ করেও যিনি শান্ত ও অচঞ্চল। সরকারি স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় সম্মান ও আর্থিক পুরস্কার পেয়েও অবিচলিত। অমল মাধুকরী ব্রতধারীকে দেখেছি। এমন তাত্ত্বিক সাধক খুঁজে পেয়েছি যিনি আপন মনে এঁকে চলেছেন বাউল তত্ত্বের মূল দর্শন ও সত্য তাঁর বর্ণময় চিত্রধারায়।
পাঠক ও অন্বেষীদের একথা জানাও দরকার যে, বাউল ফকিরদের ঐতিহ্য এখনও নতুন পদাতিকে সমাচ্ছন্ন। অনেক ছেলেমেয়ে এ পথে আসছেন। হয়তো প্রাচীনদের মতো মগ্নতা বা আত্মদীক্ষার শমতা নেই তাঁদের, হয়তো কিছুটা প্রদর্শনকামী তাঁরা, গান পরিবেশনে উদ্গ্রীব ও চঞ্চল কিন্তু তবু সচেষ্ট ও প্রতিভাবান। এমন অনেকের গান আমি ক্যাসেটে ধরে রেখেছি। ভবিষ্যতে তাঁদের অনেকে নামী শিল্পী হবেন সন্দেহ নেই।
এতদিন বাঙালি গবেষকদের অন্বেষণ ও সমীক্ষা ছিল অনেকটা একমুখী—প্রবন্ধে আখ্যানে চিত্রকলায় চলচ্চিত্রে ও কাব্যে বাংলার বাউলদেরই শুধু তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। আমার লক্ষ্য তাই প্রথম থেকেই ছিল ফকিরদের স্বতন্ত্র উন্মোচনের দিকে। সেইজন্য প্রস্তুত বইতে, জেলাওয়ারি বাউলদের তালিকার সঙ্গে বাংলার ফকিরদের একটি পঞ্জি যোগ করেছি। সেই সঙ্গে আছে দুজন ফকিরের আত্মবিবৃতি এবং একজনের আত্মকাহিনি। বীরভূম অঞ্চলে কর্মরত আমার প্রকল্প-সহকারী লিয়াকত আলি বহুদিন ফকিরদের মধ্যে রয়েছেন, এক ফকির বংশের কন্যাকে জীবনসঙ্গিনী করেছেন, তাই তাঁর সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত তথ্যগুলি খুব কাজে লেগেছে। দায়েম শাহ এবং মহম্মদ শাহ-র রচিত ফকির গানের সম্ভার তাঁর সংগৃহীত এবং এ বইতে সংযোজিত। বীরভূমের বাউলদের মধ্যে বহুদিন সঞ্চরণকারী আদিত্য মুখোপাধ্যায় অশেষ পরিশ্রমে কাজ করেছেন প্রকল্প-সহকারীরূপে। মুর্শিদাবাদে কাজ করেছেন তরুণ লোকশিল্পী ও উৎসাহী যুবা নাজমুল হক। নদিয়া, বর্ধমান ও অন্যান্য বহু জায়গায় প্রকল্প-সহকারী ছিলেন জয়ন্ত সাহা। বাউল ফকিরদের অগণিত আলোকচিত্র ও ডকুমেনটেনশনের কাজে তাঁর উদ্যম স্মরণীয়। এই সূত্রে স্বতন্ত্র উল্লেখের দাবি রাখেন উত্তর দিনাজপুরের সুভাষগঞ্জের তরণীসেন মহান্ত। সমগ্র উত্তরবঙ্গের বহু অজানা বাউল গানের শিল্পী ও গীতিকার বাউলের জীবনতথ্য ও আলোকচিত্র তাঁর আন্তরিক সংগ্রহ। তিনি নিজে একজন আচরণবাদী ও বাউলশিল্পী বলেই তাঁর কাজে বাড়তি দরদ ও নিষ্ঠা লক্ষ করা গেছে। উত্তরবঙ্গ থেকে সংগৃহীত অজস্র গানের পাণ্ডুলিপি থাকবে ভবিষ্যতের সমীক্ষার জন্য।
এই অনুসন্ধান নতুনভাবে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে সারা পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকির সমাজকে জানতে আর বুঝতে। সেই অনুভব থেকে বই লেখার সময় খেয়াল রেখেছি যাতে এটি নীরস বস্তুপুঞ্জ বা কেঠো বিবরণে ভারাক্রান্ত না হয়। এ বইয়ের প্রতিটি তথ্য বাস্তব ও জীবনস্পর্শী। ডকুমেনটেশনের প্রয়োজনে অজস্র বাউল ফকিরদের প্রত্যয় ও জীবিকা যেমন কাজে লেগেছে তেমনই সরাসরি তাঁদের জীবন পরিবেশ ও যাপনের উষ্ণতা আমাকে পদে পদে সমৃদ্ধ করেছে। এইসব অনুসন্ধান ও ভ্রমণে কেউ কেউ সঙ্গী হয়েছেন কখনও কখনও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য ছিলাম নিঃসঙ্গ। আলোকচিত্রকররূপে সঙ্গে গিয়ে মূল্যবান সহযোগিতা করেছেন রংগন চক্রবর্তী, দীপঙ্কর কুমার, সত্যেন মণ্ডল, জয়ন্ত সাহা, সঞ্জয় সাহা, ও অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। আগেকার দুটি সংস্করণে ব্যবহৃত অনেক ছবি বর্জিত হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে এবারকার নব সংস্করণে অনেক নতুন আলোকচিত্র যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের নাম অজয় কোনার, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, জয়ন্ত সাহা, তরণীসেন মহান্ত, দীপঙ্কর কুমার, দীপঙ্কর ঘোষ, রংগন চক্রবর্তী, ল্যাডলি মুখোপাধ্যায়, সত্যেন মণ্ডল, সঞ্জয় সাহা, সুগত চট্টোপাধ্যায় ও সুরজিৎ সেন। তাঁদের ধন্যবাদ! বেশ ক’টি জেলার তথ্য-আধিকারিকরা সাহায্য করেছেন বাউলদের জেলাওয়ারি পঞ্জি প্রণয়নে। ব্যক্তিগতভাবে আশ্রয় ও পরামর্শ দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন বাঁকুড়ার ছান্দার গ্রামনিবাসী বন্ধু উৎপল চক্রবর্তী ও পুরুলিয়ার বন্ধু শ্যামাপ্রসাদ বসু। জিয়াগঞ্জের অধ্যাপক শ্যামল রায়, বড় আন্দুলিয়ার রামকৃষ্ণ দে, কোটাসুরের আদিত্য মুখোপাধ্যায়, মেদিনীপুরের সমীরণ মজুমদার ও দিব্যাংশু মিশ্র, ফকিরডাঙ্গার লিয়াকত আলি, সিউড়ির বাবলি ও প্রভাত সাহা এবং অমর দে, দুবরাজপুরের অনুপম দত্ত-র কাছে নানা সূত্রে ঋণ স্বীকার করি। বাউলফকিরদের নিজেদের ডেরা, পর্ণকুটির, আখড়া ও আশ্রমের চৌহদ্দির বাইরেও তাঁদের অন্যভাবে বারেবারে পেয়েছি নানা মেলা ও মহোৎসবে। সে সব জায়গায় তাঁদের মনের আগল খুলে যায়। ঘোষপাড়া, অগ্রদ্বীপ, শেওড়াতলা, জয়দেব-কেঁদুলি ও পাথরচাপুড়ির বার্ষিক সমাবেশে বহু বছর ধরে বহু তথ্য আহরণ করেছি, যা হয়তো অন্যভাবে পাওয়া যেত না। ১৯৯৬ সালে লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত বর্ধমানের গুসকরায় সমবেত ৪৮ জন বাউলের ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে যোগ দিয়ে তাঁদের সান্নিধ্যে মজার মজার উপকরণ পেয়েছি। সেখানে নানা বর্গের ও নানা জেলার অনেক বাউলের সমাবেশ ঘটেছিল।