এ জাতীয় বহুতর দ্বান্দ্বিকতা ছাড়াও অন্য কয়েকটি সমস্যা ছিল। প্রথমত, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ঘিরে নিম্নবর্গের উপাসক সম্প্রদায়দের জীবন ও চর্যা বিষয়ে কোনও সামগ্রিক কাজ আগে কখনই হয়নি এবং হয়তো একজন একক ব্যক্তির পক্ষে তা সম্পন্ন করা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের কাজে কোনও পূর্বকল্পিত মডেল ও মেথডোলজি প্রয়োগ করা অনুচিত। লক্ষ করেছি, ইতিপূর্বে এ জাতীয় প্রয়াসে নানা অসম্পূর্ণতা থেকে গেছে। যেমন ধরা যাক, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’। উদাহরণীয় এই বইতে একজনের রচনা অন্যের নামে মুদ্রিত হয়েছে, সরেজমিন গান সংগ্রহের প্রমাণ কম, উত্তরবঙ্গের বাউল গীতিকাররা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছেন। তেমনই মানস রায়ের লেখা ‘Bauls of Birbhum’ বইতে সমাজ-নৃতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করতে গিয়ে লেখক মূল প্রতিপাদ্যকে গুলিয়ে ফেলেছেন, বহুক্ষেত্রে বাউলদের শনাক্ত করতেই ব্যর্থ হয়েছেন। বৈষ্ণব রীতি ও আচারকে তিনি বাউল আচরণবাদের থেকে আলাদা করতে পারেননি। শক্তিনাথ ঝা-র বহু শ্রমলব্ধ ‘বস্তুবাদী বাউল’ বইটি মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক। এখানে সংকটের এক নতুন মাত্রা যুক্ত হল। আসলে ‘বীরভূমের বাউল’ কিংবা ‘মুর্শিদাবাদের বাউল-সমাজ’ কথাগুলির দ্যোতনা স্পষ্ট নয়– কারণ বাউলদের সমাজগত বা গোষ্ঠীগত অবস্থিতি যখন জেলার সীমায় বলয়িত করে আমরা ধরতে চাইব তখন মনে রাখা চাই যে আমাদের জেলাগুলির সীমা প্রধানত প্রশাসনিক, যাকে বলে Administrative Boundary। প্রত্যক্ষভাবে গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরতে ঘুরতে বেশ বোঝা যায়, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বাউলফকিরদের নানা বিষয়ে প্রচুর মিল এবং তাদের জেলাগত কোনও সীমায় বিশ্লিষ্ট করা সমীচীন নয়। আবার এটাও দেখার যে নদিয়ার বাউল ফকিরদের একটা অংশ ভাবে ভাষায় চলনে অনেক বেশি সম্পৃক্ত বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-যশোহরের সঙ্গে। তেমনই দিনাজপুর বা জলপাইগুড়ির বাউলগায়করা প্রধানত রংপুর-পাবনা-রাজশাহী থেকে বাস্তুহারা হয়ে এসে এক নতুন ধারার পত্তন করেছেন—কারণ দিনাজপুর-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার অঞ্চল মূলে বাউল ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনওদিন যুক্ত নয়। এখানে গড়ে উঠেছে এক নবসমাজ এবং অন্য ধরনের বাউল গায়ক সম্প্রদায়। গড়ে উঠেছে নতুন উৎসুক শ্রোতৃসমাজও।
সরেজমিন কাজ করতে গিয়ে আরেকটি অভিজ্ঞতা অবশ্যম্ভাবী—তা হল সাধক-বাউলদের সঙ্গে গায়ক-বাউলদের আলাদা করতে না-পারা। যে বাউল গায়, সে বিশ্বাসে ও আচরণে একবারেই বাউল নয়, এমন সংখ্যা এখন পর্যাপ্ত। ফকিরিয়ানার স্বেচ্ছাগৃহীত দরিদ্র জীবন আর ফকিরি গান গাওয়ায় কোনও ভেদ নেই কিন্তু মঞ্চে আমন্ত্রিত হয়ে এমন অনেকে এখন ফকিরি গান গাইছেন যিনি পোশাকে ফকির কিন্তু সামাজিক পরিচয়ে হয়তো সচ্ছল কৃষিজীবী। গত কয়েক দশকে বাউল গান এত পেশাদারি হয়ে গেছে যে ‘বহু বেকার যুবক-যুবতী তার টানে মঞ্চে উঠছেন এবং কণ্ঠলাবণ্যে ও গায়নকৌশলে আসর মাত করছে। তাঁদের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য যশ ও অর্থ—বিকল্প জীবিকা। যাঁরা আরেকটু তৎপর আর করিতকর্মা তাঁদের লক্ষ্য বিদেশের মঞ্চ, বিদেশিনী ও ডলার। এর কোনওটিই অলীক স্বপ্ন নয়—বাস্তব। এসব জটিলতা এড়াতে যেটা করা উচিত, আমার পদ্ধতি ছিল সেটাই, সরাসরি নানা জায়গায় বাউল ফকিরদের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া।
এটা সত্যি যে বাংলার বাউল ফকিরদের অন্তরঙ্গ জীবন পরিচয় উদ্ঘাটন করতে গেলে এমনভাবে প্রশ্নাবলির বিন্যাস করতে হবে যা প্রশ্নকারীর দীর্ঘ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রণীত। কোনও বাঁধা ছকে (Set Pattern) সেই প্রশ্নাবলি গাঁথলে অভীষ্ট তথ্য না মিলতেও পারে। প্রশ্নের লব্জে সমষ্টিগত জিজ্ঞাসা (Macro) আর ব্যষ্টিগত জিজ্ঞাসা (Micro) নানাভাবে আনতে হবে। প্রশ্ন করতে করতেই বোঝা যাবে বাউল ফকিররা এক অর্থে বিচ্ছিন্ন আবার এক অর্থে খুব সম্প্রদায়গত। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানের নানা সূত্র প্রশ্ন-প্রণয়নে কাজে লাগানো যায়। আমার তা ছাড়াও বিশেষ ঝোঁক ছিল সাংগীতিক কিছু তথ্য উন্মোচনের।
আমরা পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের কয়েকশো লোকশিল্পী এবং আচরণবাদী বাউল ফকিরদের মধ্যে চার বছর পরিক্রমা করেছি। এখানে ‘আমরা’ বলতে আমি নিজে এবং তার সঙ্গে বেশ ক’জন প্রকল্প-সহকারী। এই পদ্ধতিতে যেসব উত্তর তথা জৈবনিক তথ্য উঠে এসেছে তা যেমন চমকপ্রদ তেমনই বৈচিত্রবহুল।
দেখা যাবে, একক ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত গৌণধর্মীদের অনুবিশ্ব যেমন চমৎকৃতিতে ভরা তেমনই দ্বন্দে-ছন্দে স্ববিরোধে স্পন্দিত। হয়তো দেখা যাবে যিনি শিষ্যদের কাছে মান্য ও প্রবীণ বাউলতাত্ত্বিক তিনি পেশাগতভাবে পাগলের চিকিৎসক। বীরভূমের পটুয়ার সন্তান জাতিবিদ্যা চর্চার ফাঁকে গাইছেন বাউল গান। ব্রাহ্মণতনয়া নিছক গানের সম্মোহনে বরণ করেছেন ইসলাম ধর্ম, একজন ফকিরকে তাঁর জীবনসঙ্গীরূপে পেতে। আবার অন্য এক নারী শুধু গানের প্রতি অনুরক্তির কারণে পতিপরিত্যক্তা। দ্ব্যণুক (Binary opposites) সম্পর্কের বেশ কিছু নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। যেমন একজন মারতপন্থী ফকির বিশুদ্ধ ইসলামি নামাজ রোজাতেও বিশ্বাস করেন। রোজা-নামাজ-বিরোধী একজন ফকির প্রতিবছর রমজান মাসে রাতটহলিয়ার কাজে কিছু কিছু উপার্জন করেন। বাউলরা স্বভাবত নিরুপাধি এবং খ্যাতিবিত্তের বিপরীত পথের পদাতিক অথচ প্রশ্নাবলির শেষে নিজের নামসই করতে গিয়ে একজন নিজের বিশেষণ দিয়েছেন ‘বাউলরাজা’ ও ‘ভাবরত্ন। একজন বাউল-গায়ক আচরণে ও বিশ্বাসে তান্ত্রিক—বেতার ও দূরদর্শনের শিল্পী কিন্তু জীবিকায় দেবাংশী। বাউলদের সাধনা প্রধানত জন্মরোধের অথচ প্রচুর বাউল অতিপ্রজ। কেউ কেউ নির্মমভাবে স্ত্রী ও সন্তান ত্যাগ করে বিদেশিনী নিয়ে সাধনা করছেন। কেউ আবার একের পর এক সাধনসঙ্গিনী নিয়ে পর্যায়ক্রমে কায়াবাদী। এর বিপরীত উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন গরিব ঘরের কুমারী মেয়ে বাউল গেয়ে বাবার সংসার চালাচ্ছেন। এমন বাউল বা ফকির আছেন যাঁরা নির্বাস—একেবারে চালচুলো নেই। কৃষিকাজ করেন বা মৎস্যজীবী এমন বাউল গায়ক আছেন বেশ ক’জন। হাড়ি বা ডোমবংশ-সদ্ভূত বাউল খুঁজে পাওয়া গেছে। সাঁওতাল বাউলও দুষ্প্রাপ্য নন যিনি নিজে গান রচনা করতে পারেন না কিন্তু জনপ্রিয় বাউল গান সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করে গান করেন।