লিয়াকত লক্ষ করে আশ্চর্য হচ্ছে, এদের মধ্যে হা-অন্ন ভাবটা একেবারে নেই। নেই লোভলালসা ধান্দাবাজি। দুয়েক বেলা উপোস এদের দমাতে পারে না, কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে অত্যন্ত সজাগ। লিয়াকত বোঝে:
শিষ্টাচার ভালবাসা ও সেবার এমন আচরিত প্রাত্যহিক সজাগ দৃষ্টান্ত জীবনে খুব একটা দেখিনি। মনে প্রাণে আমিও তো এই জীবন চাই। বিত্তের দাসত্বে মানসিকভাবে ডুবে থাকলে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতার যে কী হীন আপোষমুখী আত্মকেন্দ্রিক চেহারা হয়— তা চারপাশে প্রত্যহ দেখছি। এই ফকিরের সৎ বেদনাপ্রশ্নের কাছে বিস্মিত ও শ্ৰদ্ধানত আমার অবস্থান কোথায়? আমার জ্ঞানবুদ্ধিশিক্ষা, হায়, আমারই আকাঙ্ক্ষার সততাকে দমন করার কাজে লিপ্ত থেকে আমাকে বোঝাচ্ছে— যতই কাঙ্ক্ষিত হোক, ওই নিরক্ষর ফকিরের পথে অতটা হেঁটো না, মরে যাবো। না, ফকিরের ফাঁকি-ঘোচানো জীবন দৃষ্টান্তের আহ্বানে এগিয়ে গিয়ে উদ্ধার হবার যে ততখানি সামর্থ্য আমার নেই এই লজ্জায় আমার মাথা নিষ্কৃতিহীন হেঁট হয়ে আছে।
বিবেকী মানুষের অর্ন্তবাষ্পবহুল এমনতর প্রতিবেদনে আমাদের মুখোমুখি করে দেয় সামাজিক দ্বন্দ্বের অনপনেয় দ্বিচারী বিন্যাসে। ফকিরিজীবন শৈশব থেকেই মুক্ত ও হস্তক্ষেপহীন, অথচ তারা সেবাধর্মে উৎসুক। তারা সঞ্চয়হীন কিন্তু প্রত্যাশা নেই উন্নত জীবনযাপনের ভোগরাগে। বিত্তের দাসত্ব, পুঁজির বিকাশ, আমাদের আপোষমুখী ও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে, গড়ে তুলছে শ্রেণিবৈষম্য— কোথাও উৎসর্জন নেই, আত্মদানের দীক্ষা নেই। তা হলে কী করে বুঝব আমরা প্রকৃত ফকিরদের, তাদের জীবনবিশ্বাসের গানকে? সেসব গান শুধু সংগ্রহ ও সংকলন করলেই হবে না, খুঁজতে হবে সেই বনিয়াদ যা ফকিরদের জীবনসত্যে গ্রথিত। তা ততটা সুরময়, চটকদার না হতেই পারে।
লিয়াকতের অভিজ্ঞতা ও ব্যাখ্যান থেকে আরেকটা কথা স্পষ্ট হল যে, মেলামচ্ছবে সচরাচর যেসব ফকির দেখি তারা উদাহরণীয় ফকির নয়। তারা বেশির ভাগ ক্ষুৎকাতর ভিখারি, চিমটে-বাজানো গানঅলা। খাঁটি ফকিররা থাকেন তাদের অন্তর্জীবনের গুপ্ত ছকে। ‘সদা থাকো আনন্দে’ যেন তাদের আদর্শ। তবে এমন ফকিরি জীবন বিরল হয়ে আসছে। উৎসবমুখী মধ্যবিত্ত সমাজ তাদের আয়োজিত সম্মেলন ও জমায়েতে প্রায়ই ডেকে আনে বাউল ফকিরদের। এই আহ্বান তাদের সার্বিক সমাজস্রোতের অন্তর্গত করার জন্য নয়, নিজেদেরই দরদি প্রতিমা গড়তে। মঞ্চে তাদের লড়িয়ে দিচ্ছেন। লজ্জাহীন স্কুল শ্রোতাদের বিনোদন করতে না পারলে ভবিষ্যৎ নেই জেনে মরিয়া তালবাদ্যে ও বসনবিন্যাসে বাধ্যত সতর্ক যারা, তারাই কি প্রকৃত বাউল ফকির? তথ্যচিত্রে কেন শুধু তাদের অবয়ব ধরে রাখছি আমরা? গত তিন দশক ধরে আমি দেখে যাচ্ছি মূল বাউল ফকির জীবনের অন্তস্তলীয় পচন এবং মেকি প্রদর্শনকামীদের উত্থান। আমরাই তাদের কানে বিকৃতিমন্ত্র দিচ্ছি। ফলে তারা শিখে নিচ্ছে আমাদেরই স্বার্থভাষা ও প্রচারের শস্ত্র।
এর দুটো নমুনা তো চোখের সামনে দেখেছি এবং এখনও দেখছি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে প্রথম গান গাইতে দেখি নবনীদাস বাউলকে। রোদে-পোড়া তামাটে বিশেষত্বহীন চেহারা। অঙ্গে ময়লা সাদা পোশাক। তার ক’বছর পরে কলকাতার নিজাম প্যালেসে গৌরকান্তি ঝুটি বাঁধা কেশকলাপে সুপুরুষ পূর্ণদাসের গান ও বৃত্তাকার নাচ দেখে মুগ্ধ হই। গেরুয়া আলখাল্লা, গেরুয়া লুঙ্গি, একই রঙের কোমরবন্ধ ও পাগড়ি পরা পূর্ণদাসের যৌবনবিগ্রহ ও তেজি কণ্ঠ যেন অধুনাতন সময়ে একই সঙ্গে বাউল গানের পুনর্জাগরণ ও নবদ্যোতনা আনল। তাঁর কণ্ঠস্বরে, উচ্চারণে ও তারসপ্তকের টানে একটু কোমলতা ও নারীত্বের ভাব ছিল। দেখতে দেখতে সেটার অনুকরণে বাউল গায়করা হয়ে উঠল পূর্ণ-রই প্রোটোটাইপ যেন। এখনও সে ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি। বাউলের জীবনে নাচের ছন্দ থাকলেও বাউল গানের পরিবেশনে তত নান্দনিকতা থাকার কথা নয়। নানা রঙের টুকরো কাপড় সেলাই করে জুড়ে আগেকার দরিদ্র বাউল সাধকরা যে লম্বা আলখাল্লা পরত তাকে বলত গুধরি। তারই যে টেলর-মেড নব সংস্করণ এখনকার সাজানো বাউল গায়করা পরিধান করে থাকে তাতে সচেতন চমক আছে, চেষ্টিত বর্ণময়তা আছে, নজরকাড়া শৌখিনতা আছে কিন্তু প্রাণ নেই। অবশ্য এই ধরনের সাজা বাউলের ইতিহাস এদেশে নতুন নয়। লালন ফকিরের আমলে কাঙাল হরিনাথ শখের বাউল গান লিখে ফিকিরচাঁদ ভণিতা দিয়ে দল বেঁধে গান গাইতেন প্রথমে কুষ্টিয়া-কুমারখালিতে, পরে জনাদরের টানে যশোহর, ঢাকা ও কলকাতাতেও। জলধর সেনের বর্ণনায় এদের চেহারা:
দেখিতেছি একদল ফকির: সকলেরই আলখেল্লা পরা; কাহারও মুখে কৃত্রিম দাড়ী, কাহারও মাথায় কৃত্রিম বাবড়ী চুল, সকলেরই নগ্ন পদ।
প্রাণকৃষ্ণ অধিকারীর বর্ণনায়:
খিলকা, চুল, দাড়ি, টুপী ব্যবহার এবং কাহার কাহার পায়ে নূপুরও থাকিত, বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ডুগী, খমক, খুঞ্জুরি, একতারা প্রভৃতি ফকীরের সাজে তাহারা বাহির হইত।
ফিকিরচাঁদের দলের সাফল্য দেখে ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে বালকচাঁদ, গরিবচাঁদ, আজবচাঁদ ও রসিকচাঁদের দল। তাদের মধ্যে পাল্লাদারিও হত। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি।
এখানে লক্ষণীয় যে দুটো বর্ণনাতেই কৃত্রিম সাজে সজ্জিত গায়কদের ফকির বলা হয়েছে, বাউল বলা হয়নি। তাদের গেরুয়া অঙ্গবাসের উল্লেখ নেই। মীর মশাররফ হোসেন বর্ণনা করেছেন গানের ভাষায়: