প্রসন্ন হেসে লোকটি বলল, ‘একটা পদ আমরা গাই তবে তার ভণিতা পাইনি তাই ঠিক কোন মহতের রচনা বলতে পারব না। গানটা শুনুন:
গাঁজা তোর পাতায় পাতায় রস—
না খেলে যায় না বোঝা
খেলে অপযশ।
সিদ্ধি খাও বাটি বাটি
গাঁজা খেলে শরীর মাটি
মদ যে আরও মজার নেশা
এক গেলাসেই কত রস।
যত ভাবি না না না না
এ গাঁজা তো আর খাব না
ভুল করে তাই ভোলাবাবার
হয়ে গেলি বশ।
গাঁজা তোর পাতায় পাতায় রস॥’
গানের সুর ‘তুমি কাদের কুলের বউ’ মার্কা, খেমটা তালে। শুনেই বোঝা গেল এ গান কোনও মহতের রচনা নয় সেকালের থেটারের গান।
এই একটা বেশ ভাববার দিক— আমাদের মঞ্চ নাটকে আর চলচ্চিত্রে বাউল চরিত্রের বহুল ব্যবহার। এ সব চরিত্র আমদানির প্রধান কারণ অবশ্য দর্শকদের গান শোনানোর সুযোগ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ নিছক বিনোদন। তাতে খানিকটা গানের মুখবদল হয়, লৌকিক গানের প্রয়োগক্ষেত্র পেয়ে যান সংগীত পরিচালক। কে না জানে আমাদের বাবু-সংস্কৃতি তথা ভদ্রলোকদের পাতে বাউল বা ফোক টিম্বারের যে-কোনও গান চাটনির মতো জমে যায়। তবে তফাত আছে, আগেকার দিনে এ ধরনের গান ভাল লাগে বলেই সকলে উপভোগ করত এখন তাতে প্রমোটিংয়ের একটা ধুয়ো জারি হয়েছে। বলা হচ্ছে এসব গানে আছে নিম্নবর্গের রুদ্ধবাণী, সমন্বয়বাদ ও সুস্থ প্রতিবাদী চেতনা।
পশ্চিমবঙ্গের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে সেমিনার হয়, আমি নিজেই অনেক জায়গায় ওই বিষয়ে বলেছি। আধুনিক ইতিহাসচর্চার পাঠক্রমে লোকায়তদের গান এখন ‘টেক্সট’ হিসেবে সমাদৃত, বিশ্লেষণযোগ্য বিষয়— কিন্তু যারা এই জাতীয় গান রচনা করে, যারা গায়, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান ও অবমানিত অস্তিত্ব সম্পর্কে সরেজমিনে ক’জন উৎসাহী? ক’জন তাদের বিপদে আপদে পাশে আছে? নেই যে, অন্তত ফকিরদের পাশে যে তেমন কেউ নেই, সেটা স্পষ্ট। কারণ ফকিরিগানে বাণিজ্য হয় না, তাদের গানে গিমিক নেই, পোশাকের জেল্লা নেই, ‘কালচারাল এক্সপোর্ট সারকিটে’ চলে না, ফকিররা একদম বলিয়ে কইয়ে নয়, তাদের সঙ্গে মেম সাহেবরা থাকে না, তা হলে?
এইখানে এসে লিয়াকতের অভিজ্ঞতার বয়ান বেশ দিশা দেয় আমাকে। বাউল ফকিরদের নিয়ে শৌখিন মজদুরি করে না লিয়াকত। সত্তরের রাজনীতির কারণে উচ্চশিক্ষার ড্রপ আউট সে বাউল ফকিরদের বন্ধু ও সঙ্গী। তাদের নিয়ে অবিরত লেখে। এমনকী ফকিরডাঙার একজন ফকিরের মেয়েকে বিয়ে করে সে ঘর বেঁধেছে। পদে পদে বউয়ের সঙ্গে তার জীবনদৃষ্টির ফারাক ধরা পড়ে। সেই রকম একটা ঘটনা সে লিখেছে:
ফকিরডাঙায়, আমি যেখানে আছি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ধুলো ময়লার মধ্যে খেলে, গড়াগড়ি খায়। একদিন আমি বউকে, যে কিনা ফকিরের মেয়ে, বলি, ‘ছেলেমেয়েগুলো দিনরাত নোংরায় পড়ে আছে, মানা করতে পারো না?’ বউ বললে, ‘তখন থেকে নোংরা নোংরা করছ— নোংরা কোথায়, ও তো ধুলো।’ আমি অবাক। ধুলোকে নোংরা বলে চিনে এই সভ্যতার জন্ম, যেখানে আমি শিক্ষিত হয়েছি— সেই আমি অবাক। কে ঠিক? আমি না আমার বউ? আর আমি নিজেকে ঠিক বলে দাবি করতে গেলেও মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও ফাঁকি থেকে যাচ্ছে।
সংশয়ী লিয়াকতের মন উথালপাতাল হয়, সে এবারে প্রশ্ন তোলে, সংগত প্রশ্ন,
এজন্যই কি পণ্ডিতদের টীকাভাষ্য পুস্তককে ফকিররা গুরুত্ব তো দিতে চায়ই না, উলটে বিরোধিতা করে? এমনকী শাস্ত্রকেও তারা গুরুত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু এসব কথা ফকিরেরা নিজে লিখলেই তো ত্রুটিমুক্ত হত, ফাঁকি মুক্ত হত। তাও তারা লিখল না কেন?
মনে হয় গুহ্য জিনিসকে অনেকাংশে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন তারা। বিকাশশীল মহা অনন্তকে কোন বিবৃতির ছাঁচে প্রকাশ করার চেষ্টা করেননি তারা, তাতে তত্ত্বের অফুরন্ত সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই তারা ওপথ মাড়াননি, বলেছেন ‘দিল-কেতাব’ পড়ার কথা। লিখেছেন গান। এমন আভাসে ইঙ্গিতে লিখেছেন যাতে ব্যক্তর থেকে অব্যক্তই বেশি। এমনকী ব্যক্তও হয়েছে অন্তহীন রহস্য মাখানো।
লিয়াকত ফকিরকন্যা বিবাহ করলেও ফকিরিপন্থায় সামিল হয়নি। সে তাদের মরমি, দরদি, সব অর্থেই সে তাদের আত্মীয় কিন্তু তার নিজের জিজ্ঞাসা মেটেনি। তবু সে খুব গভীর বিশ্লেষণে বুঝেছে:
অনধিকারী বলে ফকিরেরা তাদের ভিতরের কথা খুলে না বলুক, তাদের সঙ্গ আমার জীবনের বহু ফাঁকি ঘোচাতে সাহায্য করেছে।
লিয়াকত এরপরে চলে গেছে ফকির-পরিমণ্ডলে দৈনন্দিন জীবনের গভীরে। তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের উৎসে। তাদের শৈশব গাথায়। লেখে:
জালাল শা ফকিরকে যত দেখি তত অবাক হই—সম্পত্তি নেই, মাটির ঘর, কারো কাছে হাত পাতেন না। অথচ মানুষের অযাচিত দানেই তার সংসার চলে। আর তাতে ঘুরিয়ে চলে মানুষেরই সেবা। যেখানেই থাকুন তিনি, যেখানেই যান, তার সঙ্গে পাঁচ-দশজন লোক জুটবেই; তিনি যা খান, তারাও তাই খাবে। যদি উপস্থিত সকলকে খাওয়ানোর পয়সা না থাকে, যত খিদে পাক, নিজে একা কিছুতেই খাবেন না। কাউকে খাওয়াতেও বলবেন না। নিজে থেকে যদি কেউ খাওয়ায়, সে কথা ভিন্ন। এরপর আছে দিনরাতের যে-কোনও সময়ে, এমনকী গভীর রাতেও, ভক্তদের নিয়ে বাড়ি ফেরা।…
ছেলেমেয়েদের প্রতি তার প্রাণাধিক ভালবাসা। অথচ ছেলেমেয়েগুলো ডানপিটে, কিছুটা জংলি এবং স্বাধীন। নিজেদের ইচ্ছামতো বেড়ে উঠেছে। এত ছোট বয়স থেকে এত হস্তক্ষেপহীন স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ আর কোথাও কোনও ছেলেমেয়ে পায় কিনা জানা নেই। নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি মারামারিও লেগে আছে।… অথচ প্রতিটি ছেলেমেয়ের ভেতরটা অদ্ভুত নির্মল। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালবাসায় শিশুরাও যে কতখানি এগিয়ে এদের না দেখলে বোঝা যাবে না। একটু বড়রা দিনরাত মানুষকে জল এনে দিচ্ছে, চা এনে দিচ্ছে, ধুচ্ছে এঁটো কাপ গেলাস থালা— জাত-পাতের প্রশ্ন নেই, চেনা-অচেনার প্রশ্ন নেই, অর্থবান-ভেদাভেদ নেই— সবার, সবারই।…সঞ্চয় নেই— সঞ্চয় না থাকার উদ্বেগও নেই।