‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ’ বলে সুলতান দিব্যহাসি হাসে।
এদিকে একজন বেশ তরিবত করে গাঁজা দুলতে থাকে। ছিলিমে ভরার আগেই ফকির নিয়ে আসেন থালির উপর রাখা চায়ের কাপ। জলভরতি মগটা ছিল পাশেই। চা খেয়ে সকলে হাতে জল নেয়। এরপর চলে ছিলিমে দম।
গাঁজা শেষ হতেই ওদের নিজেদের মধ্যে ঘটে গেল ইশারা বিনিময়। জল ফেলে দিয়ে একজন হাতে তুলে নিল মগ। সুলতান নিল থালি। অন্য একজন পকেট থেকে চিরুনি বের করে কাগজ সেঁটে নিয়ে ধরল মুখে। ফকিরের হাতে উঠে এল চিমটে। অতর্কিতে বেজে উঠল থালা মগ চিরুনিবাঁশি ও চিমটে। এবং সেই সঙ্গে সুলতানের গলা— ‘কেউ ফিরে না খালি হাতে খাজা বাবার দরবারে।’
আয়োজনহীন বাদ্যযন্ত্ৰছুট এই যে গানের বেদনা সেখানে হৃদয়ের আর্তিটাই বড়, বাজনা বাদ্যি পোশাক মাইক ক্যাসিও লাগে না।
লিয়াকত চোখ-কান-খোলা মুক্তমনের আধুনিক যুবা। বাউল ফকিরদের সঙ্গ সে বহুভাবে করেছে বহুদিন। ১৯৯৯ সালের বাউল আর ফকিরদের তফাত সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই বলে:
বাউলরা, যাদের দামী গেরুয়া আলখাল্লার উপর তাপ্লিসৌখীন বাহারে মোড়ক। এরা কারা? ঐতিহ্যের দৃঢ় অবস্থান ছেড়ে তাদের নাচ আজ পণ্যদূষিত, আত্মীকরণহীন ধার করা আমদানীর ভেজালে সাধনাচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক মজা ও ফুর্তির উপাদানে পর্যবসিত। হরেক বাদ্যযন্ত্র ছাড়া তারা আর গানের কথা ভাবতে পারে না। স্টেজে আসার আগে সাজগোজ করতে তারা যে সময় নেয় তা তো প্রসাধনবাজির চূড়ান্ত। এদের পেছন পেছন বাউলপ্রেমিক নামে হিন্দু মধ্যবিত্তের এক শহুরে বাউণ্ডুলে অংশ, গবেষক, মেম ও বিদেশে পাচার করার জন্য ফড়ে ঘুরছে। কুঁড়ে ঘর থেকে নিজেকে বিকিয়ে দালানে উঠেছে বাউল। পরনে বিদেশী জিনসের প্যান্ট শার্ট, পাছার নীচে মোটর সাইকেল। খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি, সরকারী বেসরকারী অনুষ্ঠান সর্বত্র এদের নিয়ে মাতামাতি।
কিন্তু ফকিরেরা যে তিমিরে সেই তিমিরে। তাদের পেছনে কেউ নেই। পার্থিব, আকাঙ্ক্ষা পূরণের লালসাজনিত বাণিজ্যিক আত্মপ্রতিষ্ঠা থেকে দূরে থাকে বলেই সর্বত্রই তারা অবহেলিত, এমনকি মূল্যায়নহীনও। মুসলিম মধ্যবিত্তের রসিক-সাজা বাউণ্ডুলে বখাটে অংশও এদের পেছনে নেই।
… নাচ ও বাদ্যযন্ত্রহীন গানেও যে আমি এত বেজে উঠতে পারি। —দরকার ছিল জানার, নিজেকে এভাবে খুঁজে পাবার।
লিয়াকতের লেখাটা থেকে একটা কথা স্পষ্ট, যে বাংলার সমাজের ফকিররা যেমন উপেক্ষিত ও ব্রাত্য, কলমজীবীদের দরদ ও করুণাও তেমনই পায়নি তারা। প্রদর্শনপটু বাউলদের পাশে তাদের অনাড়ম্বর মগ্ন সাধনা গবেষক ও দূরদর্শীদের হয়তো টানে না। তাদের সাধনায় অবশ্য গানের ততটা প্রাধান্যও নেই। তবে লিয়াকতের বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে ফকিররাও বাউলদের মতো গাঁজা খায়।
গাঁজা কেন জানি না লৌকিক সাধকদের গ্রাস করে রেখেছে বহুদিন। এতে তাদের নাকি সাধনায় তীব্র একাগ্রতা আনে। হতে পারে, তবে বাউলদের ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি এবং গানের গলা নষ্ট হতে আমি অনেক দেখেছি। লালনের গানে গাঁজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে। প্রমথ চৌধুরী ‘আত্মকথা’-য় তাঁর বাল্যে শোনা একটা নেড়ানেড়ির গান উদ্ধৃত করেছেন। গানটি এইরকম:
যদি গৌর চাস কাঁথা নে ধনী।
সকালবেলায় ভিক্ষায় যাবি
ঘরে এসে তেল মাখাবি
আর পেতে দিবি বিছানাখানি।
আর গাঁজায় কলকের আগুন দিবি
দিনরজনী।
গানের বাণী অনুসরণ করলে বোঝা সহজ যে বাউল বা ভেকধারীদের উনিশ শতকে ভদ্ৰশ্রেণিরা কী চোখে দেখতেন। বাউলরা হঠাৎ কীভাবে সমাজে জনপ্রিয় হল তার কারণ অনুসন্ধান আজও হয়নি, তবে এখনকার ছন্নমতি শহুরে যুবাদের গাঁজার প্রতি টান সুবিদিত। তাই কেঁদুলি বা নানা মেলায় বাউলদের আসরে ভদ্রলোকদের সন্তানরা ব্যাপক গাঁজা টানে— এমন দৃশ্য দেখতে আমার চোখ খুব অভ্যস্ত। আজকাল ট্রাউজার ও টপ পরা ছাত্রীদেরও দুয়েকজনকে দেখছি গাঁজায় দম দিতে।
মাঝে মাঝে বাউল ফকিরদের নিজস্ব জমায়েতে গাঁজার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুনেছি। তাতে খুব ফল হয়েছে বলে দেখিনি। এখনকার যে-কোনও বাউল মেলায় তাদের সব ক’টি ঠেকে ঢুকলেই ভক করে একটা গন্ধ নাকে লাগে— তীব্র গাঁজার গন্ধ। বাউলের ঝুলিতে ছিলিম বা ‘বাঁশি’ থাকবেই। সেই সঙ্গে গাঁজাপাতা টুকরো করার জন্য ছোট্ট যন্ত্র। আসরে প্রকাশ্যেই গাঁজার সেবা প্রস্তুতি খুব সাধারণ দৃশ্য। তারপরে হাসি হাসি মুখ, নিমীলিত চোখ আর মাঝে মাঝে ‘জয় গুরু’ বলে বেমক্কা হাঁক। বাউলানীদের অবশ্য গাঁজা খেতে বড় একটা দেখা যায় না, তবে মেলার গানের আসরে একটা দুটো পারভার্ট মহিলা থাকেই। হঠাৎ হয়তো সে নাচতে শুরু করল কিংবা এলিয়ে পড়ল বাউলের অঙ্গে। যুগলের রসের খেলা বলে কথা। সবটাই তো সাত্ত্বিক নয়— অনেকটাই কামের পরিতৃপ্তি।
বাংলায় যত মেলা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কেঁদুলির জয়দেব মেলা। পৌষ সংক্রান্তির দিনে অজয়ের তীরে এ মেলা বহুদিনের। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর যৌবনে কাশী থেকে কেঁদুলি এসেছেন। এখন এ-মেলা অনেক পণ্যবাহী ও বাণিজ্যমুখী হয়ে গেছে, সাধক বাউলদের দেখা মেলে কম, তবু নেই নেই করে এখনও নানা বর্গের গৌণ ধর্মের সাধকরা এখনও আসেন। এইরকম একজন সাধুর আখড়ায় চলছিল গাঁজার আসর। ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার, সকলে ঊর্ধ্বমুখী শিবনেত্র। তার মধ্যে একজন বুঁদ হয়ে গাঁজা সাজছিল। মানুষটা তখনও গাঁজা সেবন শুরু করেনি, হাবেভাবে বেশ টনকো। তাকে বললাম, ‘গাঁজা নিয়ে গান জানেন? কেউ লিখেছেন?’