শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় দেখা যায় অন্য এক দৃশ্য। সেখানে বাউলরা থাকে একটা চালার তলায়, ফকিররা থাকে একটু তফাতে আরেকটা চালায়। চিরকাল হিন্দুমুসলমানের মধ্যেকার বিভেদরেখা মুছে দিতে যে-রবীন্দ্রনাথ সমন্বয়বাণী প্রচার করে গেছেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাসত্রে বাউল ও ফকিরদের আলাদা আলাদা ক্যাম্প দেখলে দুঃখ হয়। পৌষ মাসের তীব্র শীতে মেলার মাঠের ছুরির মতো উত্তুরে বাতাসে টেম্পোরির আস্তানায় চটের আবরণে, খড় ও কম্বলের শয্যায় এসব সাধক ও বাউলদের রাত্রিবাস বিশ্বভারতীর সহৃদয় মানবিকতারই প্রকাশ নিশ্চয়ই। যদিও রয়ে গেছে অনতিদূরে নাট্যঘরের বিরাট প্রকোষ্ঠ, যেখানে হাজারের বেশি বাউল ফকির থাকতে পারে স্বচ্ছন্দে ও উষ্ণতায়। কর্তৃপক্ষের অবশ্য সেই কবোষ্ণ অনুভূতিটুকু নেই লোকায়তদের প্রতি। কলকাতা ও বঙ্গের নানা দিক দেশ থেকে আসা পৌষমেলার ভদ্র ও মার্জিত ভদ্রসমাজ (শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা তাদের বলে ‘বোটু’, অর্থাৎ বোকা টুরিস্ট) আসরে বসে নিমীলিত নেত্রে বাউল ফকিরের গান শোনেন। কোনও কোনও অত্যুৎসাহী ব্যক্তি ভিডিও তোলেন, দূরদর্শন ও খাসখবরের প্রতিনিধিরা ব্যস্ত হয়ে ঘোরেন। কেউ খোঁজ রাখে না মেলা চত্বরের দক্ষিণে হু হু শীতে সারারাত কেঁপেছে এই গায়কের দল। সকালে লাইন বেঁধে দাড়িয়েছে নাম পঞ্জিভুক্ত করার জন্যে। নইলে খাবার ও জলখাবারের স্লিপ পাবে না, রাহা খরচ ও দক্ষিণা পাবে না। লম্বা লাইনে দাঁড়ানো দীনভিখারি সেই মানুষগুলোকে দেখলে চোখে জল আসবে।
বাউলদের মধ্যে বসে আছেন ছাউনির একটেরে আশি ছুঁই ছুঁই সনাতনদাস বাউল। সরকার তাঁকে বহুমান্য লালন পুরস্কার দিয়েছে, দৃশ্যকলা আকাডেমি দিয়েছে লোকশিল্পীর পুরস্কার। কিন্তু তাতে কী? তিনি তো ভি. আই. পি নন যে রতনকুঠিতে থাকবেন! তাই যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন সেই তৃণস্তরে তাঁর স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। তিনি অন্যত্র কেনই বা থাকবেন? আউল বাউল সকলের তো একই ব্যবস্থা, একই আহার, একই শৌচস্থান। আমি বললাম, ‘আপনি এখানে? দেখে লজ্জা লাগছে।’
মনে পড়ল সনাতনদাস তাঁর খয়েরবুনি গ্রামের আশ্রমে আমাকে কত সমাদর ও আশ্রয় দিয়েছেন। খাইয়েছেন বেলের শরবত, মণ্ডা। সেই মানুষের এই অনাদর? দোষরোপ করে লাভ নেই, এই হল লোকায়তদের প্রতি আমাদের গড় দৃষ্টিভঙ্গি। সনাতনদাস কিন্তু হেসে বললেন, ‘আমরা তো মাটিরই মানুষ, গলায় মেঠো সুর। মরলে এই মাটিতেই হবে সমাধি। এখানে সবাই সমান বাবা।’
পরানপুরের এনায়েতউল্লা ফকিরের সঙ্গে দেখা। পরানপুরে তাঁর বড় দোতলা বাড়িতে রাত্রিবাস করেছি। এখানে তাঁর ভূমিশয্যা বরাদ্দ। বললাম, ‘এখানে বাউল আর ফকিরদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। কেমন লাগছে?’
—বাউল ফকিরের মধ্যেকার ভেদ আমরা চাই ঘোচাতে, এঁরা সেটা বহাল রাখতে চান। জানেন তো আপনি, আমাদের নদে-মুর্শিদাবাদে ‘বাউল-ফকির সংঘ’ আছে। আমরা একজোট হয়ে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ি। অথচ এখানে আলাদা আস্তানা আলাদা আসর।
—বাউলদের তুলনায় ফকিরদের অবস্থা বেশ খারাপ, তাই না?
—হ্যাঁ, ফকিররা তো ফিকিরি জানে না। খুব গরিব। সামাজিক সম্মান নেই। শরিয়ত মানে বলে মুসলিম সমাজের সঙ্গে ওঠাবসা নেই, উলটে তাদের হাতে মার খেতে হয়। ঘরদোর পুড়িয়ে দেয়, চুল কামিয়ে দেয়, একতারা ভাঙে। তা ছাড়া ধরুন, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিদেশে তো ফকির পাঠায় না, পাঠায় বাউল। তারা মোটা টাকা আয় করে ফেরে। তাদের নিয়ে তথ্যচিত্র হয়, শিল্পীরা তাদের ছবি আঁকে। ফকিরদের পোশাকটার জেল্লা নেই, এই দেখুন আমার সাদা তহবন্দ সাদা পিরান। আজকাল কেউ কেউ আসরে তাই কালো জোব্বা পরে। কী করবে?
—এখানে যেসব ফকির দেখছি তাদের মধ্যে সাধক ক’জন, গায়কই বা ক’জন? কে এদের ডেকেছে?
এনায়েতউল্লা ম্লান হেসে বললেন, ‘ফকিরি একটা সাধনপন্থা। শরিয়তির বদলে মারুফতি। আমাদের সাধনায় ধ্যানজপ জিকিরের কাজ বড়, গানের দিকটা তত জোরালো নয়। ওটা বাউলদের বেশি।’
—তা হলে এখানে কারা এসেছে? আপনাদের ছাউনিতে অতজন যে আছে তারা কারা?
—বেশির ভাগই চিমটে-বাজানো ভিখিরি। পথে ঘাটে ট্রেনে এরা ভিক্ষে করে। সত্যি কথা বলতে কি, এরা এখানে এসেছে দু’দিন ধরে দু’বেলা খেতে পাবে পেট ভরে, কিছু টাকাও পাবে সেই আশায়। এরা ফকির নয় সবাই, গরিব।
—তা হলে এখানে যে সব শ্রোতা ফকিরি গান শুনছে তারা কী শুনছে? কোন গান? খাঁটি ফকিরি গান তবে কি নেই?
এবারে এনায়েত আমাকে লজ্জায় ফেলেন। খাঁটি ফকিরি খানদান ওঁদের। ফকিরের বাড়িতে থেকে তাঁদের ঘরানার ফকিরি সাধনা স্বচক্ষে দেখেছি। বীরভূমের ফকিরডাঙায় দায়েম শা’র ফকিরি গান সংগ্রহ করেছি, শুনেছি কবু শা’র গান। সেসব গানের জাতই আলাদা। শান্তিনিকেতনে ফকিরি আসরে যাদের গাইতে দেখেছি তারা দীনভিখারি বেশির ভাগ। তাদের গান এখানে দেখছি প্রধানত লালনের, যিনি আসলে বাউল পরম্পরার মানুষ।
এসব বিবরণ লিখতে লিখতে লিয়াকত আলির একটা আত্মস্মৃতি (‘আমার ফকির-সঙ্গ’) মনে এল। এখানে বীরভূম জেলার শাসপুর গাঁয়ের দরিদ্রতম ফকিরদের ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদন আছে। তাদের গানের আসরের বিবরণ এই রকম:
(লিয়াকত ফকিরদের জিজ্ঞেস করে,) ‘কীভাবে আপনারা গাইবেন? বাদ্যযন্ত্র কিছু তো দেখছি না।’