বাউল গানের হতেছে প্রচার—
কত রামাশ্যামা বাউল সেজে
গান গেয়ে নিচ্ছে বাহার।
দেখি একজন বাউল
তার কালো কোঁকড়া চুল
তার ভাঙা হাতে বেঁধে ঘড়ি
মারছে কত গুল।
ও সে নকল সুরে গাইছে বাউল
লোকে বলছে চমৎকার।
বাউল বেতারশিল্পী হলে
ও তার লেজটি যায় ফুলে
লঘুগুরু মানে না আর
আপন মর্ম যায় ভুলে—
আবার হোটেলেতে বসতে পেলে
হয়ে যায় সব একাকার।
এই গানের শব্দ-চিত্রে তবু হালফিলের পুরো ছবিটা ফোটেনি। সেই ছবি অনেকটাই পরিহাসময় হাস্যকর। কিছুটা প্রহসনও বটে। একেবারে দরিদ্রতম বাউলের বাড়ি গিয়ে হয়তো বললাম, ‘একটা ফোটো নেব আপনার।’
—ফোটো তুলবেন? দাঁড়ান আসছি।
ভাবছিলাম একেবারে গ্রামীণ আবহে গরিব বাউলের ছবি নেব একটা, সেটাই তো প্রকৃত ছবি! কিন্তু দশ মিনিট পরে সামনে এসে যে দাঁড়াল তার পরনে ফিটফাট গেরুয়া পোশাক, ইস্তিরি করা, গলায় দুটো মেডেল। একতারাটা ওপরে তুলে সপ্রতিভ পোজ দিয়ে এমন দাঁড়াল যে আমার মেজাজ গেল খিঁচড়ে।
ছবির সাটার টিপতেই ব্যাকুল প্রশ্ন: ‘কুথায় ছাপা হবে গো? আনন্দবাজারে না বর্তমানে?’
একবার একজন বাউল একটা অ্যালবাম খুলে গর্বিত উক্তি করল, ‘এই ফোটোক’টা দেখুন গো। দিল্লির প্রগতি ময়দানে তোলা। আমার পাশে ছোনিয়া গান্ধি, চেনা যাচ্ছে?’
অথচ তিরিশ বছর আগেও এমনটা ছিল না। এখন যেমন দেখি সর্বত্র, কিছু একটা উৎসব বা সম্মেলন হলেই তার অনুষ্ঠানসূচিতে থাকবেই থাকবে বাউল সংগীত। যারা গেরুয়া পরে উপস্থিত হবে তাদের শতকরা সত্তর জনের জীবন ও বিশ্বাসে বাউলের বা-ও নেই। কিন্তু ভাবভঙ্গিটা আছে যোলো আনা। সঙ্গের যন্ত্রানুষঙ্গ খুব চড়া পর্দার। ক্যাসিও, উঁচুভাবে বাঁধা তবলা—একজন দক্ষ হারমোনিয়ামবাদক প্রথমে সুর তুলবে। বাড়বে দুনে চৌদুনে তালের বাহার। জলদ আরও জলদ। এইভাবে দু’-পাঁচ মিনিট বাজনা গানের পরে বাউল গায়ক কর্ডলেসে ‘ভোলামন’ বলে ফুকরে উঠবে। ব্যস, জমে গেল শ্রোতা ও দর্শকরা। হাতে হাতে বেজে উঠল তালির ঝড়। পপ, র্যাপ কিংবা ব্ৰেথলেস গানের আসরে এই শ্রোতারাই থাকে। এরাই জীবনমুখী আর ব্র্যান্ড গানকে জাতে তুলেছে। বাউল গানের ক্ষেত্রে এসব শ্রোতার বাড়তি টান গানের বাণীর দুর্বোধ্যতা বা প্রচ্ছন্ন অশালীন ইঙ্গিতের দিকে। কাটজুডিডাঙার বাউল সম্মেলনের তিনদিনের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন সম্পাদক। তাতে লেখা আছে:
লোকমঞ্চে শেষের দিকে দু’-চারজন যুবকের অনুরোধে এক শিল্পী অশ্লীল সংগীত পরিবেশন করলে উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে তা থামিয়ে দেওয়া হলে সেই যুবকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায় এবং কিছুক্ষণ পরে তা থেমে যায়। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী কোন বাউল সংগীত পরিবেশন করা চলবে না।
এই প্রতিবেদনকে ব্যতিক্রম ভাবার কোনও কারণ নেই। সব নয়, কিন্তু কিছু কিছু লোকসংস্কৃতির আসর যে-রুচিহীনতা ও ক্ষণ উত্তেজনার মাদকতায় খেপে উঠেছে তা বুঝতে গেলে আসরের গানের বাণীতে কান পাতাই যথেষ্ট। যেমন ধরা যাক:
মায়ের মধ্যে আমার বাবা গিয়েছে
আমার যেতে ইচ্ছে হয়েছে
আমি যাব কোন দ্বার দিয়া?
শুনেই শ্রোতারা হই হই করে উঠবে। যুবক বাউল আর খমকধারী নৃত্য-সঙ্গী ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকবে। বাউলের পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, তার ওপরে নানা ছিট কাপড়ে কোলাজ করা, দর্জি দিয়ে বানানো, চকচকে জ্যাকেট। গাইতে গাইতে নাচের টানে বাউল যখন দর্শকদের দিকে পেছন ফিরবে তখন দেখা যাবে জ্যাকেটের পিঠে হয়তো লেখা: ‘জয়গুরু’ কিংবা একটা একতারার ছবি। এটা শো-বিজনেসের অঙ্গ। নবাসনের হরিপদ বাউল আমাকে বলেছিলেন:
এটাসিং পেটাসিং ঝুলিটেপা উদাসীন
মাগমরা ধামাপোড়া এই হয় ছয়।
অর্থাৎ এরাই ছয় ক্যাটিগরির ভ্রষ্ট বাউল। এটাসিং মানে যৌনতাসর্বস্ব কামুক, পেটাসিং মানে পেটুক, ঝুলিটেপা হল তারা যারা মাঝে মাঝে ভিক্ষার ঝুলি টিপে পরখ করে কতটা সংগ্রহ হল। উদাসীন মানে আপাত উদাসীনের ভড়ং যাদের মাগমরা বলতে যারা স্ত্রীবিয়োগের ফলে বাউল সেজেছে নতুন সঙ্গিনীর খোঁজে। ধামাপোড়া মানে যাদের কাজই হল ধামা বোঝাই করা বা কালেকশন।
যে-কোনও বাউল সম্মেলনে গেলে আমার স্বভাব হল উৎসব মঞ্চ বা দর্শক আসনে না থেকে চারদিক ঘোরা এবং ঘুরতে ঘুরতে সেইখানে যাওয়া সেই ঘরে, যেখানে রাখা হয়েছে বাউলদের। সেখানে বসে-থাকা গায়কদের সে সময়ে গেরুয়া পোশাক-আশাক আলখাল্লা বা পাগড়ি থাকে না— সাধারণ বেশবাসে সাধারণ চেহারার গ্রামীণ মানুষ তখন তারা। বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত কিন্তু আমাদের মতো শহুরে জিজ্ঞাসুদের দেখলেই সতর্ক সচেতন হয়ে ওঠে। এদের অনেকে ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে পাকাপোক্ত। খুব জাঁকিয়ে নিজের নাম, গুরুর নাম, গুরুপাটের ঠিকানা, নিজের বাস্তুবাড়ির নিশানা দেয়। আমি অনেক সময় ইচ্ছে করে এদের নির্বোধের মতো প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা বাউল মানে কী?’
শুনে খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকবে, তারপরে গাঁজাটানা বিলোলচোখ মেলে উত্তর আসবে: ‘ব কথার অর্থ বায়ুআশ্রিত, উ বলতে যথাতথা আর ল মানে লয়। অর্থাৎ যারা বায়ুযোগে সাধনা করে, সর্বত্র যাতায়াত করে এবং লয় পেয়ে যায় সবার মনে। সকলেই যাদের ভালবাসে।’ এমন বিচিত্র সংজ্ঞা কে যে তাদের শিখিয়েছে কে জানে। নানা জমায়েতে এ-বাঁধিবোল যে কতবার শুনেছি!