একেই আমরা সাহেবি ভাষায় বলি ওরাল ট্রাডিশন। সাতের দশকে দুশ্যন জাভাতিয়েল খোদ ময়মনসিংহে গিয়ে মাঠচাষিদের কাছে সেইসব ব্যালাড শুনেছিলেন যা নাকি পঁচাত্তর বছর আগে গিয়ে আঁকাড়া সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে। এতগুলো বছর গানের শব্দ কিছুটা পালটে গিয়েছিল অবশ্য। তবু শ্রুতি ও স্মৃতির পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখে গানের ধারা, লোক ঐতিহ্য।
সেটারই বড় আকাল ইদানীং, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে। আজকাল বাউল গায়ক বলে দুয়েকজন মানুষ সব আসরে মিলবে, যারা বাউল সাধনার কিছুই জানে না। গলা আছে, গান গায়। নামযশের কে না কাঙাল! গুসকরার বাউল উৎসবে একজন যুবা আমার পাশের চেয়ারে বসে কেবলই উদ্যোক্তাদের তেল দিচ্ছিল, আমার গানটা একটু আগে দিন, তাড়াতাড়ি ফিরব বাড়ি, কাল অফিস।
অফিস? শুনে এবারে অবাক চোখে তাকাই। বছর তিরিশের বেঁটেখাটো মানুষ, পরেছে এক লম্বা ঝুলের ঝিনচাক রঙিন পাঞ্জাবি, ওই একই রঙের চেপা পাজামা। নিজেই পরিচয় দিল সে ব্রাহ্মণ সন্তান, কাজ করে বি. ডি. ও অফিসে। একজন জানালে, শনি রবিবারে তার বাড়িতে বসে গানের স্কুল। নিজে শেখায় নজরুলগীতি। একসেট গেরুয়া রঙের টেরিকটনের বাউলবেশ আছে। বাউলের আসর হচ্ছে শুনলেই হাজির হয়। পটিয়ে পাটিয়ে মঞ্চে ওঠে— তারপরে তারস্বরে চেঁচিয়ে গায়:
আমি আউলও নই বাউলও নই
আমি মানুষের গান গেয়ে যাই।
ছেলেছোকরা শ্রোতারা হাততালি দেয়। সবাই তার নাম দিয়েছে ‘সুপার সেভেন’। এমন নাম কেন জিগ্যেস করলে তারা বললে, মোট চারখানা বাউল গান ও জানে তাই সুপার সেভেন। হেসে ভাবি, তাই তো। সুপার সেভেন ডিস্কে তো চারখানা গানই থাকে।
এদের যেমন লোক-ঐতিহ্য নেই, তেমনই কণ্ঠে নেই লাগসই গানের পরম্পরাগত স্মৃতি। তিরিশ বছর আগেও এমনটা দেখিনি। ওই যে বলছিলাম বাউল পরিবারটির কথা। বাউলানী যাচ্ছিল যজ্ঞডুমুর পাড়তে, এমন সময় গুরুভাই শুকচাঁদকে আসতে দেখে ঘরে ফিরে এল হাসিমুখে। কারণ কী? সেটা বোঝা গেল শুকচাঁদের কাঁধের বস্তা দেখে। একগ্লাস জল চেয়ে নিয়ে, খেয়ে, দুটো বাতাসা চিবিয়ে, প্রথমে পা ধুলো শুকচাঁদ। তাকে ততক্ষণে পাখার বাতাস করতে লেগেছে আখড়ার একমাত্র নারী। সেটা কেড়ে নিয়ে শুকচাঁদ বলে, ‘ঠাকরুন পাখাটা আমাকে দাও—এত সুখ কি বাউলের জীবনে সহ্য হয়? পথবোরেগী মানুষ আমরা। আসছি দু’ক্রোশ পথ হেঁটে। কাঁধে বস্তা, তাতে চাল ডাল আনাজপাতি। পথই বা কই? টাঁড় জমির ফাটল দিয়ে হলকা বেরোচ্ছে—উঁচুনিচু টিপি। এবারে ঠাকরুন বস্তা খোললা, আজাড় কর মালপত্তর। গুরুভাইকে দেখাও। জয় গুরু।’
গুরুভাই হৃষ্টচিত্তে দেখলে চাল ডাল ছাড়াও এক পাত্র ঘি, একছড়া চাঁপা কলা, থোড়, কাঁচকলা, এঁচোড় আর পটল। ক’টা কচি আম, শসা। কচুপাতায় করে অনেকটা কুচোচিংড়ি ও পুঁটি মাছ। দেখে সোচ্ছ্বাসে বললে, ‘কী ভাই পুরো বাগানটাই সাফ করে আনলে?’
শুকচাঁদ বললে, ‘সবই গুরুর কৃপা। গতকাল গিয়েছিলাম গুরুপাটে, হঠাৎ এমনই মন টানল, তাই। গিয়ে দেখি এক নতুন শিষ্য দিবসী করছে, তারই বিরাট মচ্ছব। আজ ভোরে উঠতে মা-গোঁসাই এইসব বস্তায় পুরে দিয়ে বললেন, যাও তোমার সেই আমডাঙার গুরুভাইকে দিয়ে এসো। মচ্ছবের থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি এসব।’
—কুচো চিংড়ি আর পুঁটি? এসব টাটকা মাছও কি মচ্ছবের বাসি মাল নাকি?
—আরে না না। পথে আসতে একটা সোঁতার ধারে ক’জন মালো মাছ ধরছিল। তাদের ক’টা গান শোনালাম। খুশি হয়ে বলল, ‘যাচ্ছ কোথায়?’ বললাম, ‘গুরুভাইয়ের আখড়ায়।’ তাই শুনে কচুপাতায় করে মাছ দিয়ে বলল, ‘ভাল গান শোনালে, ক’টা মাছ নিয়ে যাও। ওখানে রেঁধে খেয়ো।’
—জয় গুরু। সবই কপাল— এই হল আকাশবৃত্তি—না চাইতেই জল। নইলে দ্যাখো ভাই কী আতান্তরে পড়েছিলেম। বাড়িতে ভদ্রলোক মান্যমান অতিথি। যজ্ঞিডুমুর, বড়ি, কাঁঠালবিচি আর পেঁপে দিয়ে কোনওরকমে সেবা দেবার কথা হচ্ছিল, আর এখন?
—যজ্ঞিডুমুরের বদলে আস্ত যজ্ঞি, কি বলো? একটা গান মনে পড়ল গো —শোনো— এ হল ফুলবাসউদ্দিনের লেখা পদ—
দেখে তোমার কাজগুলা যায় না দয়াল বলা।
সাঁই দয়াল নামের এমনি গুণ
পান্তা ভাতে মেলে না নুন—
কেউ খায় ঘি মাখন কারো কাঁধে দাও ঝোলা
কেউ সুখ-সাগরে ডুব দিয়া রয়
কারো কেঁদে কেঁদে জনম যায়।
একেই বলে ভাবের পরম্পরায় গানের উঠে আসা। সেটা এখনকার বাউল সমাবেশে তেমন আর হবার জো নেই। এমন লাগসই গান সময় বুঝে তাক করে ক’জন আর গাইতে পারে? ক’জনের মুরোদ আছে? বেশির ভাগ সুপার সেভেন না হলেও বড়জোর একটা লং প্লেইং রেকর্ড।
বাউলদের জীবনধারাও তো আগের চেয়ে অনেকটা পালটে গেছে। আজকাল কোনও কোনও আখড়ার দাওয়ায় দেখেছি মোপেড গাড়ি। কারুর কারুর হাতে ঘড়ি, গায়ে বিদেশি জাম্পার। ঠিকানা চাইলে এগিয়ে দেবে একটা ঝকঝকে কার্ড। তার ওপরদিকে একটা একতারা-আঁকা লোগো। নীচে ইংরিজি হরফে লেখা। অমুকদাস বাউল। সেন্টার ফর যোগ অ্যান্ড মেডিটেশন। ভিলেজ…। ডিস্ট্রিক্ট…। পিন নং…। ফোন…
একেবারে অবিশ্বাস্য নয়। শহুরে ধাপ্পাবাজি, লোকদেখানি, প্রচার বাসনা এখন প্রবল। আগেকার কত কত বাউল আসর দেখেছি শান্ত গৃহাঙ্গনে। বড়জোর একটা ছাউনি বা চাঁদোয়া টাঙানো, সবাই মাটিতে বসে। গান-শোনা মাদুর বা খেজুর পাতার তালাই পেতে। এখন হয় ডেকরেটর ডেকে নানারঙের বাহারি কাপড়ে মঞ্চ বানানো। শ্রোতারা বসবে চেয়ারে। মঞ্চের বা ব্যাকগ্রাউন্ডে থার্মোকল কেটে বাউল উৎসবের জানানদারি ক্যালিগ্রাফিও দেখবার মতো। বাউলের ‘ব’ হরফের পাশে আকারচিহ্নের বদলে বেঁকানো একতারা। এক সম্মেলনে তিনতিনটে মঞ্চ— লোকমঞ্চ গণমঞ্চ মুক্তমঞ্চ। তবু সামাল দেওয়া যায় না, এত গায়ক এত বাউল এবং এত শ্রোতাও। যেন ভোজবাজির মতো রাতারাতি বাউল গানের গায়ক ও শ্রোতাদের বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। রায়গঞ্জের কাছে সুভাষগঞ্জের বাউল উৎসব কিংবা নদিয়ার কদমখালির লালনমেলা বা বাঁকুড়ার নবাসনের সমাবেশ— একইরকম বিপুল জনস্রোতের প্রবাহ আর অগণন বাউলের ভিড়। সবাই বাউল, সবাই গেরুয়া, সবাই গায়ক। ব্যাপারস্যাপার দেখে একজন গান বেঁধেছে: