এই রকম নানা অভিজ্ঞতায় স্নাত হতে হতে পুরো সত্তর দশকটাই কেটে গেছে। শুধুই শুনে যাওয়া আর দেখে যাওয়া। কেবলই অঞ্জলি ভরে গান সংগ্রহ করা—লোকতাত্ত্বিকদের কাছে বারেবারে গিয়ে বোঝার চেষ্টা সেসব গানের গূঢ় সত্য। এমনভাবে অকাতরে পাওয়া যেসব অনুভব আর দিশা, তারই আলোয় আশির দশকে বছর তিনেক ধরে আমি লিখে ফেলি যে-সন্দর্ভ বা তত্ত্ববিশ্বের আখ্যান, তা নানা খণ্ড-শিরোনামে ‘এক্ষণ’ ও ‘বারোমাস’ পত্রে প্রকাশিত হয়ে এলিটিস্ট বিজ্ঞজনকে নাড়া দেয়। শেষমেষ রচনাগুলি দুই মলাটের বাঁধন মেনে ‘গভীর নির্জন পথে’ নামে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে পুস্তকাকার লাভ করে প্রকাশ পায় ১৯৮৯ সালে। সে বই এখনও এই ২০০৯ সালেও, একই রকম জনাদর পেয়ে চলেছে— পত্রপত্রিকার খুব অনুকূল আলোচনার ভাগ্য অর্জন করেছে। এতদিনকার অনুন্মোচিত যৌন-যোগে রহস্যময় অন্তর্মূঢ় বাউল জীবন সম্পর্কে প্রাঞ্জলভাবে জানতে পেরে পাঠকদের অনেকে যেমন চমৎকৃত ও চমকিত হয়েছেন, তেমনই কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন বইটি রোমান্টিক, অর্থাৎ স্বকল্পিত। সেটা অবশ্য নিন্দাছলে প্রশংসাই, কারণ এমন আলো-আঁধারি দোলাচলের মরমি জীবনকে নিছক কল্পনায় ফুটিয়ে তোলা, সে তো সপ্রতিভ সৃজনশীলতার আরেক উচ্চারণ। যাই হোক, এমনতর সমাদরে-সংশয়ে দিন কাটছিল, কিন্তু বাউল ফকিরদের বিষয়ে আমার অন্বেষণ আর অনুসন্ধিৎসার ক্ষান্তি ঘটেনি। সেই থেকে, কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিছক কৌতূহলে কিংবা বলা উচিত গভীর লোকায়তের টানে, বছরের পর বছর ঘুরেই চলেছি। ইত্যবসরে লালন শাহকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লেখা এবং পশ্চিমবঙ্গের মেলা ও মহোৎসব নিয়ে ধারাবাহিক রচনার কাজ সাঙ্গ হল। বাউল ফকিরদের নিয়ে নতুন করে কোনও আলাদা বই লেখার পরিকল্পনা বা মশলা ছিল না। ১৯৯৪ সালে এসে গেল কলেজীয় অধ্যাপনার শেষে অবসরের দিন। ভাবলাম, এতদিনে এসেছে সেই প্রত্যাশিত সময়, এবারে নিজের মতো পড়াশুনা করে কাটবে দায়হীন দিনগুলি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যবিভাগে সপ্তাহে দুটি দিন অতিথি-অধ্যাপকের লঘু দায়িত্বের আনন্দে বেশ কাটছিল অনুসন্ধানী তরুণ সহকর্মীদের সান্নিধ্যে। হঠাৎ এসে গেল নতুন আহ্বান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের তৎকালীন সচিব চন্দনকুমার চক্রবর্তী ১৯৯৬ সালে আমাকে ভার নিতে বললেন পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকিরদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানের প্রকল্প রূপায়ণের গুরু দায়িত্বের।
প্রথমে মনের মধ্যে একটা প্রতিরোধ এসেছিল সরকারি ছকের কৃত্রিম পদ্ধতি কিংবা পূর্ব নির্দেশিকার বাধ্যবাধকতার কথা ভেবে। সরকারি সমীক্ষাপত্র বিষয়ে, এদেশে, নানা কারণে, একরকম অনীহা ও বিরূপতা আছে। সম্ভবত সেগুলি প্রায়ই হয়ে পড়ে কেঠো বিবরণ কিংবা কেজো প্রতিবেদন। সরেজমিন গবেষণা, যাকে ভদ্রভাষায় বলে ক্ষেত্রসমীক্ষা—(বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি বইতে বলা হয়েছে ‘মাঠ গবেষণা’) যার ভিত্তি হল মৌখিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন, তার সিদ্ধি বেশ কঠিন। সারা পশ্চিমবঙ্গ ব্যেপে কাজের বিশাল পরিধি, ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও বহুমুখী, এমন প্রকল্প রূপায়ণ আয়াসসাধ্য। তাই দ্বিধা জেগেছিল।
কিন্তু আগ্রহ ও উত্তেজনাও জাগরূক ছিল, কারণ সচিব মহাশয় প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রকল্পের কাজে কোনও খবরদারি বা পূর্বকল্পিত সরকারি ছক থাকবে না, কাজটা করা যাবে স্বাধীনভাবে। অবশ্য একটা ব্যক্তিগত কৌতূহলও ছিল—সত্তর দশকে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান ঘিরে যে-জনপদে বাউলফকিরদের ঘনিষ্ঠভাবে একদা পর্যবেক্ষণ করেছিলাম নিজের খেয়ালে, দু’দশক পরে তাদের পরিবর্তন ও নতুন সমাজ কাঠামোয় তাদের ভূমিকা জানবার আগ্রহ জাগল। এই ক’দশকে আমাদের দেশে নিম্নবর্গ, লোকধর্ম ও মরমিয়া সমাজ সম্পর্কে জনসাধারণের উৎসাহ এবং জানবার আগ্রহ ইতিমধ্যে অনেক পরিমাণে বেড়ে গেছে—প্রণিধানযোগ্য বেশ ক’টি বইও বেরিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে। দেশি ও বিদেশি গবেষকরা গ্রামে-গঞ্জে নগরে অনেক সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তেমনই গ্রামীণ সমাজে নানা রূপান্তরের লক্ষণ আর নগরায়ণের ছাপ পড়েছে অনেক প্রগাঢ়ভাবে। এই ধরনের রূপান্তর আর গ্রামিক দৃশ্যপট জানতে এবং সেই পরিপ্রেক্ষণীতে নতুন করে লোকায়ত শিল্পী সমাজকে বুঝতে চাওয়া স্বাভাবিক। সহসা সেই সুযোগ এসে গেল, অবশ্য এসে গেল ব্যাপক প্রসারণে—কারণ এবারে অনুসন্ধানের ক্ষেত্র-পরিসর হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গব্যাপী, যার একটা প্রধান অথচ উপেক্ষিত-অনালোকিত অংশ হল ফরাক্কা পেরিয়ে বিশাল উত্তরবঙ্গ।
এটা নিশ্চিতভাবে নির্ণীত হল যে, বীরভূম-বাঁকুড়া-মুর্শিদাবাদ-নদিয়া পশ্চিমবঙ্গের এই চারটি জেলা বাউলফকির অধ্যুষিত। বর্ধমান-মেদিনীপুর-পুরুলিয়ায় বাউলদের কিছু সন্ধান মিললেও দুই চব্বিশ পরগনা-হাওড়া-হুগলি বাউল সমাবেশের দিক থেকে দীন। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বাউলদের বসতি, সমাবেশ ও সংখ্যা নিঃসন্দেহে মালদহ-কোচবিহার-দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির চেয়ে বেশি।
এইবারে সমস্যা দেখা দিল বাউল ফকিরদের শনাক্তকরণ নিয়ে। রাঢ়ের বাউল আর উত্তরবঙ্গের বাউল একেবারে আলাদা—গানের বিষয় ও গানের ঠাটে, গায়নে, এমনকী বাউলের অঙ্গবাসে। বীরভূমের ফকিরদের জীবনযাপনের ছকের সঙ্গে নদিয়ার ফকিরদের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পূর্ণদাসের গানের অঙ্গ যে বাউলনৃত্যবিভঙ্গ তার সঙ্গে বাঁকুড়ার সনাতনদাসের নৃত্যশৈলী সম্পূর্ণ পৃথক। প্রতিতুলনায় উত্তরবঙ্গের বলহরি দাসের নাচ একেবারে অন্য ধারার। নদিয়ার চাকদা-র ষষ্ঠী খ্যাপা আবার ভিন্নতর কৌশলে নাচেন। বীরভূমের ফকিরদের গানে বেহালা সঙ্গত আর নদিয়ার ফকিরদের গানে দোতারা ও আনন্দলহরী ব্যবহার দু’ধরনের দ্যোতনা আনে। সূক্ষ্মবিচারে আরও নানাবর্গের পার্থক্য চোখে পড়ে। যেমন বাউলের সাধনসঙ্গিনীদের ভূমিকা। রাঢ়ে বা নদিয়ায় যত্রতত্র তাদের সহজেই দেখা যায়, উত্তরবঙ্গে তারা বিরলদৃষ্ট। আরেকটা গুরুতর প্রশ্ন হল, সমাজ এদের কেমন চোখে দেখছে। উত্তরবঙ্গে বাউলরা গৃহীত, রাঢ়ে তারা সমাজজীবনের সম্পৃক্ত, নদিয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অথচ মুর্শিদাবাদে তারা অত্যাচারিত ও বিপন্ন।