এই যে আচরিত বিনয়বচন এ তাদের সাধনার অঙ্গ—গুরু কৃষ্ণ-বৈষ্ণব-গুরুভাই বা অতিথি তাদের বহুমান্য। শিষ্য তাদের সন্তানতুল্য। নিজের কথা উজিয়ে বলা পাপ, গুরুর নিষেধ। তারা উলটে বলে, আপনারা জ্ঞানীগুণী মান্যজন, আমাদের তো জ্ঞানের পথ নয়— আমরা ভাবের রসিক। যা দুয়েকটা কথা জানি বা বলতে পারি সেও মহাজনদের পদ বা মহতের বাণী, গুরুর শেখানো।
কিন্তু গুরু যেটা শেখাননি সেটাও এদের স্ব-অধিকার। ব্যাপারটা হল ঘরে হা-অন্ন কিন্তু তা বাইরে জানান না-দেওয়া। এসে যাবে কিছু দিয়ে যাবে কেউ, এমন বিশ্বাস নিয়ে যাকে বলে আকাশবৃত্তি। উপস্থিত অতিথিকে দেওয়া যাক একটু আখের গুড়ের পানা— গরমে হেঁটে এসেছেন এতটা পথ, শরীরটা ঠান্ডা হোক। সঙ্গিনীকে নির্দেশ, ‘অতিথি দেবতা—ওঁকে একটু বাতাস করো, তারপর দ্যাখো ঘরের কোণে হাঁড়ি পাতিলে দু’মুঠো চাল ঠিকই আছে, একটু ডাল। ফুটিয়ে দাও দুটি। আর ওই তো দেখছি পেঁপে গাছে পুরুষ্টু দুটো পেঁপে। পেড়ে নিয়ে তরকারি করো।’
এমন সহজ সমাধান, এত সরল জীবনদর্শন, আমি কোথায় পাব? শহুরে মানুষ, কেতাকানুনে দুরস্ত। অতিথি আপ্যায়নে নিজের দৈন্য ঢেকে রাখি। বাউলের সঙ্গিনী তার সঙ্গীকে বলে, ‘চালেডালে ঘেঁটে খাওয়াব কী পেঁপের তরকারি রাঁধব সে তো আমার ব্যাপার। কেন, ঘরে কি কাঁঠালবিচি নেই? কুমড়ো বড়ি? ওই তো পুকুর ঘাটে যজ্ঞিডুমুরের গাছ দেখতে পাচ্ছ— পেড়ে আনব খুনি কটা।’
মনে ভাবি, কত আর নিজেকে ঢাকবে মা জননী? বৈরাগিনীর ছদ্মবেশে এতো ঘোর সংসারিণী! অথচ আশ্চর্য বই কী যে এদের সংসার ধর্ম সে-অর্থে নেই, সন্তানও নেই। আজ এখানে কাল ওখানে। বিয়েই হয়নি। কাঁঠালবিচি আর বড়িসঞ্চয়ী এমন যে-গিন্নি সে কিন্তু যে-কোনও দিন ছেড়ে যেতে পারে বাউলকে। মাঠে ঘাটে ঘোরাফেরার ফাঁকে যে-নারী লক্ষ রাখে সিমের ঝোপ বা বেওয়ারিশ যজ্ঞিডুমুরের গাছের ফলন্ত রূপের দিকে সে-ই হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে পারে মেলাখেলা থেকে নতুন বাউলনাগরকে নিয়ে। এ যে ভাবের পথ।
তবে উপস্থিত সেই নারী আমার মতো অতিথিকে নিয়ে বেশ মশগুল। কিন্তু কখনও শুনিনি এরা আমাকে আমার জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেছে। নিজেদের বর্তমানকে নিয়েই এরা বর্তিয়ে আছে। দারিদ্র্য আর অভাবও এদের বাস্তব। তাই আমার সংগ্রহে এমন একটা গানও আছে যে,
আমার এই পেটের চিন্তে
এমন আর চিন্তে কিছু নাই—
চাউল ফুরাল ডাইল ফুরাল
সদাই গিন্নি বলে তাই।
যখন আমি নামাজ পড়ি
তখন চিন্তা ওঠে ভারী
কীসে চলবে দিনগুজারি
সেজদা দিয়ে ভাবি তাই—
এখানে ‘সেজদা’ শব্দটার মানে প্রণাম। আরবি শব্দ। নামাজের সময়ে মাটিতে কপাল ঠুকে প্রণাম। ধর্মপ্রাণ ‘মুসল্লি’ যাদের বলে তারা সেজদা কপালে কালো দাগ করে ফেলে। এই গানে সেজদা দেবার সেই মগ্ন আত্মহারা ভাবটা যেন নেই। উপাস্যকে সেজদা দিতে গিয়ে এমন আশ্চর্য গানের গীতিকারের মনের চিন্তা; কীসে চলবে তার দিনগুজরান? এরপরে গানের শেষের কথাগুলো আরও সাংঘাতিক। সাধনভজনের উপাদান-উপকরণ নিয়ে সে ঠাট্টা করে বলে।
ও সদা পেটের জ্বালা জপমালা
আমি তসবি মালায় জপি তাই।
এ একেবারে বুভুক্ষু মানুষের লেখা নাঙ্গা গান— এর আর রাখঢাক নেই। পেটের জ্বালা-ই যে-জীবনে হয়ে ওঠে জপমালা সেই জীবনকে আমরা আর কতটুকু জানি?
এদিকে যজ্ঞিডুমুরের সন্ধানী নারী আঁকশি হাতে রওনা হতে গিয়ে ফিরে আসে একমুখ হেসে। বলে, ওই দ্যাখো মাঠপাড়ে আসছে তোমার গুরুভাই শুকচাঁদ।
সবই গুরুর কৃপা—বলে বাউল হাসে— জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। বাড়িতে অতিথি আর দরজায় শুকচাঁদ, মানে সুখের চাঁদ উঠল আজ, তাও দিনদুপুরে। যাকে বলে দিনদুপুরে চাঁদের উদয়।
জীবন-আস্বাদের এও একটা ধরন। সবকিছুকে শব্দের লজে সুন্দর করে নেওয়া। তাতেই শুকচাঁদ হয়ে উঠল সুখচাঁদ, সেই চাঁদের উদয় কিনা দিনদুপুরে। আসলে ‘দিনদুপুরে চাঁদের উদয়’, ‘দিনদুপুরে জোয়ার আসা’ এসব বয়ানের গোপন দেহতত্ত্বের অন্তর্ভাষ্য আছে, যা সাধকরাই বোঝে, ঠারেঠোরে বোঝায় চাষি শিষ্যদের। বুঝিয়ে বলেই সাবধান করে;
আরে ঐ না নদীর মাসে মাসে
দিনদুপুরে জোয়ার আসে
ড্যাঙ্গাডহর যায় রে ভেসে
বিদ্ঘুটে বন্যে এসে।
এবারে সে নিজেই নিচুগলায় মুনিশদের বলবে, ‘কিছু বুঝলে? এ কোন্ নদী, কীসের বন্যে?’
প্রশ্ন শুনে মুনিশ বাগালদের কেউ কেউ ভ্যাবলা মেরে থাকে, কেউ বলে, এসব নিগূঢ় ব্যাপার। কেউ বলে, এসব গোপ্ত কথা জানতে গেলে গুরু ধরতে হয়। একজন খ্যা খ্যা করে হেসে বলে উঠল, ‘ধুর, নিগূঢ়টিগূঢ় কিছু নেই, স্ত্রীলোকের মাসিকের কথা বলা হচ্ছে।’
এবারে হাতে ধানের গুছি রইল পড়ে, শুরু হল পাল্লাদাড়ি। ‘বল্ দিকিনি বাঁশি বলে কাকে?’ ‘ও খুব সোজা—বাঁশি মানে গাঁজার কলকে’। ‘বল্ দিকিনি বাবার পুকুর কাকে বলে?’ ‘ওটা অশৈল কথা’। এবারে একজন রসিক চাষা বলে, ‘বেশ, একটা ভাল ধাঁধা শোন দিকি—ব্যাঙাচি খায় দুই পুকুরের জল— এবারে বল্। ওসব গোপ্তটোপ্ত কিছু নয়, সোজাসাপটা ব্যাপার। কী? পারলিনে তো কেউ? তবে শোন্, ব্যাঙাচি মানে বাচ্চা শিশু, তো সে খাচ্ছে মায়ের দুধ— দুই পুকুর কিনা দুটো স্তন।’ চলল এবারে গ্রাম্য ধাঁধা আর প্রবাদ প্রবচনের চর্চা— ধানরোয়া রইল পড়ে। সে হবে’খন রয়ে সয়ে। উপস্থিত পাওয়া গেছে একটা রসের বিষয়। তো এইরকম সব মাঠফসলের আসরে আমার কতদিন কেটে গেছে। মিলেছি ওদের সঙ্গে। গুরু কিংবা মুর্শেদের বাড়িতে আলাপ হয়েছে হয়তো— বলেছে, যাবেন আমাদের গাঁয়ে, জমিতে কাজ করতে করতে কত গান হবে, টুকে নেবেন ইচ্ছেমতো। বাবু, আমরা কি গোষ্ঠগোপাল না পূর্ণদাস যে আপনি বললেন আর আমি গেয়ে দিলাম। ওঁদের এলেম কত, আমরা সব বেএলেম, নাকি বলো গো তোমরা। আমাদের সব কথার পিঠে কথা, গানের জবাবে গান।