তার মানে এক প্রস্ফুটমান পেশাদার শিল্পীর জন্ম হচ্ছে আমাদের সামনে। দেখতে হবে পনেরো মিনিট ধরে বাউলের ক্যারিকেচার। আট-দশ বছরের মানবক, ছোট মাপের আলখাল্লা ও পাগড়ি, কোমরে বেল্ট বাঁধা গেরুয়াবাস, গলায় কাচের মালা, রঙিন কোমরবন্ধ, কপালে আর নাকে স্পষ্ট রসকলি—যেন বাউলের শিশু সংস্করণ। চিকন কণ্ঠে গাবগুবি বাজিয়ে সেও গেয়ে ওঠে অচিন পাখির খাঁচার রহস্য গান। যাকে বলে ছোট মুখে বড় কথা। গণতোষণে কোনও বাধা পড়ে না। একটা গান শেষ হলে জনগণেরা হাততালি দেন বিপুল আবেগে। কোনও অত্যুৎসাহী শ্রোতা মঞ্চে উঠে তার বুকে সেফটি পিন দিয়ে এঁটে দেন তরতাজা দশ টাকার নোট, নিজের কৃতিত্বে নিজেই হাসেন দন্ত বিকশিত করে। নবীনকিশোর দ্বিগুণ উৎসাহে এবারে দ্বিতীয় গানের সঙ্গে তোলপাড় নাচ শুরু করে।
এ ধরনের বাউলবিলাসে সবসময়ে উদ্যোক্তাদের হাতে রাশ থাকে তা নয়। গানের পর গান হতে হতে আসরের মাঝে একফাঁকে চকিতে ঘটে যায় এমনতর শিশু সংস্করণের বাউল-উজ্জীবন-প্রকল্প। অবিবেচনার এও এক রকমফের। আরেক সম্মেলনে দেখেছিলাম বাউলদের বিপন্নতার অন্যতর দৃশ্য। দুপুর-বিকেল ধরে হল সম্মেলনের উদ্বোধন আর ভারী মানুষদের ভাষণ। সন্ধে থেকে হবে বাউল গান। মাঝখানে দু’ঘণ্টার অবকাশে কী করা যায়? উদ্যোক্তারা আয়োজন করে দিলেন আলোচনাচক্র বা গ্রুপ ডিসকাশন। তার আলোচ্য বিষয়গুলি হল:
১ ভোগবাদ ব্যতিরেকে বাউল হল অধ্যাত্মবাদের অগ্রদূত।
২. সম্প্রীতি রক্ষায় ও গণশিক্ষা প্রসারে বাউল সংগীত।
৩, অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং সুস্থ সংস্কৃতি রক্ষায় বাউল সংগীত।
৪. বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বাউল সংগীত বা বাউল শিল্পীদের অবস্থান।
৫. বাউল সংগীত ও বাউল শিল্পীদের মর্যাদায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা।
হঠাৎ এমন সুচিন্তিত তালিকা দেখলে মনে হবে ব্যাপারখানা কি? এ আলোচনা কাদের জন্য? কারাই বা এর অংশগ্রহণকারী? শ্রোতাই বা কে?
না, এ-কোনও চটজলদি এলোমেলো বিষয়-পরিকল্পনা নয়। অনুষ্ঠান সূচিতে আগে থেকে মুদ্রিত ছিল এই আলোচনাচক্র ও তার আলোচকের নাম। কৌতুহল ছিল। দেখতে পেলাম মঞ্চে পাতা হল একটি করে টেবিল, আর তাকে ঘিরে আট-দশটি ফোল্ডিং চেয়ার। মঞ্চ ভরে উঠল পাঁচটি টেবিল আর গোটা পঞ্চাশেক চেয়ারে। এবারে এক-এক চেয়ারে বসলেন এক-একজন বুদ্ধিজীবী আর তাঁকে মাঝখানে রেখে আটজন করে বাউল। একেক ভদ্রলোক একখানা ফাইল খুলে তাঁর সামনের বৃত্তাকারে বসা বাউলদের নিয়ে শুরু করলেন গ্রুপ ডিসকাশন। জনা বিশেক শ্রোতা বা দর্শক নীচে চেয়ারে বসে দৃশ্যটি দেখছেন কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। যেন থিয়েটারের মঞ্চে জোনাল অ্যাকটিং, শোনা যাচ্ছে অস্পষ্ট গুজগুজ গুঞ্জন। খানিকক্ষণ দেখেশুনে শ্রোতারা কেটে পড়লেন। আমার কোথাও যাবার ছিল না তাই গুটি গুটি হাজির হলাম মঞ্চে। সে যে কী অবর্ণনীয় বেদনাময় দৃশ্য!
বুদ্ধিজীবী যুবাটি মহা উৎসাহে বাউলদের নানা কূটকচালি প্রশ্ন করছেন আর বাউলরা এ ওর দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত মুখে আঁকছে হতাশার মুদ্রা। গানে যারা মুখর, প্রশ্নোত্তরে তারা একেবারে মূক। আমি একজন বুদ্ধিজীবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন?’
—তিনি গভীর খেদে বললেন, ‘না। এঁরা তো একটা কথাও বলছেন না।’
—তা হলে উপায়?
—একটা কিছু তো করতেই হবে, দেখি। যাঁরা স্পনসরার তাঁরা গ্রুপ ডিসকাশনের জন্য টাকা ইয়ার মার্ক করে দিয়েছেন যে রিপোর্ট একটা দিতেই হবে।
বুদ্ধিজীবীদের প্রণীত সেই কপোলকল্পিত রিপোর্ট লিখিত আকারে জমা পড়েছে। কিন্তু তাতে ওই বাউলদের কী লাভ হয়েছে? এ সব সম্মেলনকে কে বা কারা প্রকৃত দিশা দেবে?
আগে একেবারে একা একা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম। খুঁজতে খুঁজতে সন্ধান মিলত একটা কি দুটো গ্রাম্য বাউল বা ফকিরের। গাঁয়ের একটেরে তারা পড়ে থাকত। আশপাশের গাঁ-গঞ্জে মাধুকরী করে, সঙ্গিনীসহ গান গেয়ে সামান্য কিছু পয়সা, চাল ডাল তরকারি পেত। ডেরা বা আখড়ায় এসে তাই ফুটিয়ে দুটো গ্রাসাচ্ছাদন চলত আর ছিল নিভৃত সাধনভজন। উঠোনে থাকত দুয়েকটা শ্বেতটগর বা সন্ধ্যামণি ফুলের গাছ, জুঁই বা মাধবীলতার ঝাড়। হয়তো একটা বেল গাছ বা নারকেল গাছ। চালাঘরের মেটে দেয়ালে মেলা থেকে কেনা শ্রীগৌরাঙ্গের ছবি, আপন গুরুর পায়ের ছাপ আর নানা জায়গা থেকে আনা এটা ওটা ছবি। ভেতরের ঘরের হুকে টাঙানো একতারা, গুপিযন্ত্র—বড়জোর একটা শ্রীখোল। মচ্ছবের দিনে খোলটা লাগে। রোজকার গান ওই একতারা-গুপিযন্ত্রেই হয়ে যায়। ভাত খাওয়ার জন্য আছে দু’খানা অ্যালুমিনিয়ামের থালা, দুটো গ্লাস, করোয়া-কিস্তি। মাঠে ঘাটে স্নান-শৌচ। পরনে নিতান্ত সস্তা সাদা ধুতি লুঙ্গি করে পরা আর মার্কিন কাপড়ের ফতুয়া, সঙ্গিনীর সাদা জামা ও থান শাড়ি। সঙ্গিনীর গলায় কণ্ঠি, হাত রিক্ত— ব্যস, একেবারে নিরাভরণ। বাউলের কণ্ঠে গুনগুন গান, ঊর্ধ্বমুখী চোখ, সদাপ্রসন্ন আনন, বিনীত বচন নম্ব্রস্বরে। আমি কখনও উদ্ধত স্বভাবের লোকায়ত সাধক দেখিনি। তাদের কাছে গেলে প্রথমে চা-মুড়ি সেবার কথা বলবেই, পরে দুপুরে দুটি অন্নসেবার কথাও বলবে। কুণ্ঠা জানাবে তার দীন আয়োজনের জন্য। বলবে, বাবু আমরা গরিব বাউল। একেবারে ফকির। সংসারের ফিকির জানিনে। তবু আপনি কষ্ট করে এসেছেন এই আমার সৌভাগ্য— গুরু কৃপা। আমি অধম, অজ্ঞান —কী বা পাবেন?