সচরাচর শহরে আর মফস্সলে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা বাউলমেলা, আলোচনাচক্র বা সেমিনার সংগঠন করেন তাঁদের কেবল দরদ আর সহানুভূতি থাকলেই যথেষ্ট নয়। হতে হবে অনেক বাস্তববাদী এবং মানবিকতা সম্পন্ন। বাউল ফকিরদের জীবন ও কর্মশালা সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। তা হলেই একমাত্র বোঝা যাবে, কোন পরিবেশ থেকে তারা কোথায় এসেছে, সম্মেলনে কী তাদের প্রত্যাশা ও চাহিদা, কেন তাদের অতৃপ্তি। একটা কথা তো খুব স্পষ্ট। বহুদিনের প্রত্যাশা নিয়ে কাক-ভোরে রওনা হয়ে, সারা দিনের স্বেদ ঝরিয়ে, ক্লান্ত তবু ক্লান্তিহীন যে-গায়ক মানুষটি মঞ্চে উঠেছে তাকে কি একটামাত্র গান গাইতে দেওয়া সংগত? উদ্যোক্তাদের সময় কম, মাত্র তিন-চার ঘণ্টায় কুড়িজনকে গান গাওয়াতে হবে, তার দায় কি ওই গ্রামীণ শিল্পীর নিতে হবে? গানই তো তার জীবন, তার মোক্ষণ, তার প্রতিবাদ। বিদ্যমান সমাজের মধ্যে বাস করে, শত দুঃখ কষ্টেও, তার গান তাকে বাঁচিয়ে রাখে। সন্ধে থেকে বাউল সাজে সেজে তার সে কী অধীর অপেক্ষা! যে মুখচোরা তার আর ডাক পড়ে না মঞ্চে। অবশেষে যখন ডাক পড়ল তখন রাত দশটা। খিদে তেষ্টায় জর্জরিত, ঘর্মাক্ত, সন্ধেবেলা থেকে অপেক্ষাতুর, কেমন গাইবে সে? অথচ এবারে ভাল না-গাইতে পারলে পরের বার উদ্যোক্তারা ডাকবেন না। সেইজন্য এ জাতীয় সম্মেলনে বাউল-ফকিররা যখন গায়, প্রাণপণে গায়, তখন তাদের দিকে আমি তাকাতে পারি না। তার মনের আন্তরিক ইচ্ছা তো আমি জানি— প্রথমে গাইতে চাইবে গুরুবন্দনা, তার পরে মনঃশিক্ষা, তার পরে দৈন্য, সবশেষে কোনও একটি তত্ত্বগান বা মুর্শিদা গান। কিন্তু তার সময় সুযোগ কই? ঘোষক বলে দিয়েছেন ‘এখন গান করবেন সদানন্দ বাউল। তাঁর গান শেষ হলে রসিকদাস বাউল গাইবেন। তাঁকে তৈরি থাকতে বলা হচ্ছে।’ সদানন্দ মঞ্চে উঠে প্রথমে দেখে মাঠ ভরতি দর্শক শ্রোতা। করুণভাবে চোখ বোলায় সামনের সারির ভি.আই.পি কিংবা সভাধিপতির দিকে— গবেষক আর অধ্যাপকদের দিকে— সাংবাদিকদের দিকে। ভাবে, কাকে গান শোনাতে এসেছে সে? কোন সেই একখানা আশ্চর্য গান তার পরশমণি, যা সবাইকে স্পর্শ করবে?
কাটজুড়িডাঙার সম্মেলনের লিখিত প্রতিবেদনে যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে আমাদের অন্য সমাবেশের অভিজ্ঞতা একইরকম। বলা হচ্ছে:
বাউল শিল্পীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় দুটি মঞ্চ করা সত্ত্বেও এক-একজন বাউল শিল্পী একটি বা দুটির বেশি সংগীত পরিবেশন করার সুযোগ পাননি। ফলে তাঁদের একটু ক্ষোভ থেকে যায়। তবে তাঁরা প্রত্যেকেই গান পরিবেশন করে দেখিয়ে দিয়েছেন বাউল গান কাকে বলে।
উদ্যোক্তাদের আত্মতুষ্টি আর শিল্পীদের ক্ষোভ একেবারে সমান্তরাল রেখায় অবস্থিত। কাঠজুড়িডাঙার বাউল মেলাই যে আদর্শ তা বলছি না। তাঁদের উদ্যমকে খাটো করবার কোনও উদ্দেশ্য নেই আমার। কদমখালির লালনমেলায় একই অবিবেচনা কাজ করছে। সেখানে আবার ‘বাংলাদেশ থেকে আগত’ বাউলদের খাতির একটু বেশি—টিভি ও অন্য চ্যানেলের আগন্তুক ক্যামেরাম্যান রিপোর্টারদের তৎপরতা চোখে পড়বার মতো। হঠাৎ উড়ে-এসে-জুড়ে বসা কোনও অধ্যাপক বা মন্ত্রী মহোদয়ের লালনবিষয়ক ভাষণ— যাতে সেই ‘ক্লিশে’ অর্থাৎ জাতপাতহীন মানবতা, হিন্দু মুসলমান সংহতি আর ‘এমন সমাজ কবে সৃজন হবে’ বলে দীর্ঘশ্বাস থাকবেই। তার পরে শুরু হবে বাউল গানের ধারাবাহিক, অপরিকল্পিত, অবাধ, অসংগত বিন্যাসে কিম্ভূত এক জগাখিচুড়ি। দেখা যাবে শুদ্ধ গানের পাশে নাবালক রচনা, কখনও হালকা মস্করার গান, কারুর শুধুই লালনসম্বল পরিবেশন, কেউ গেয়ে দিল হাফ-কীর্তন। কে কোন গান গাইবে, গানের পর্যায়ক্রমিক কিছু নিবেদন করা সম্ভব কি না, এসব উদ্যোক্তাদের মধ্যে কে ভাববে? সন্ধ্যার মধ্যে বৃহৎ জনতার হই-চই, ফেরিঅলার চিৎকার, তেলেভাজা ও জিলিপির দোকানে গ্রামীণ ভিড়, মানুষের বাঁধভাঙা ঢল। তারা একটা অনির্দিষ্ট জিনিস শুনতে এসেছে। বাউলের অবয়ব, পোশাক ও গানভঙ্গিকে তারা অন্বেষণ করছে। গানের একটা ধাঁচ তাদের জানা আছে, সেটা চাইছে। শান্তভাবে নিবেদিত আত্মস্থ বাউলের পরিবেশন তাদের ভাল লাগার কথা নয়— তাই যত রাত বাড়ে ততই গায়নের লাগাম খসে পড়ে। মত্ত তাল আর উদ্দাম নাচের ছন্দে গান পরিবেশন করে নবীন বাউলেরা। আসর জমিয়ে দেয়। প্রবীণ, বিবেচক, ভাবুক গায়করা কিছুটা হতভম্ব ও দিশাহারা হয়ে পড়েন। বাউল গান হয়তো তাঁদের বিশ্বাসে বিনোদনের বিষয়ীভূত নয়— তাঁদের গায়নও অনেক অন্তর্মগ্ন, নবীন কণ্ঠের তেজ বা জাদু তাঁদের না-থাকারই কথা। তাঁরা চাইছিলেন গানের মধ্যে দিয়ে কিছু বলতে—কোনও গভীর বাণী। কে শুনবে?
ইদানীং এ-জাতীয় গণমঞ্চে বা লোকমঞ্চে আরেক উৎপাত শুরু হয়েছে। সাধারণভাবে প্রধান গায়কের সঙ্গে তিন-চারজন সংগতীয়া ওঠে। মঞ্চে, দাঁড়িয়ে বা বসে সংগত করেন। কোনও কোনও দলে দেখা যায় এক বালক বা নবীনকিশোর সঙ্গে এসে মঞ্চে বসে। বাউল পিতা বা গুরু স্নেহবশে তাকে কাছে এনে সস্নেহে বলেন, ‘এই ছোট্ট ছেলেটা এইটুকু বয়সেই চমৎকার বাউল গাইছে— আপনারা শুনুন। দেখুন কণ্ঠে কী ভাব! এখনও হয়তো তত্ত্ব বোঝে না কিন্তু ভাল গায়। আপনারা শ্রোতারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে ওঁর গান শুনুন, উৎসাহ দিন।’