সেবার বাঁকুড়া শহরের গায়ে কাটজুড়িডাঙায় একটা বাউল মেলা ও আলোচনাচক্র হল দু’দিন ধরে। আমার সেখানে নিমন্ত্রণ ছিল। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সেখানকার রাঢ় একাডেমি এবং তার প্রধান উদ্যোক্তা অচিন্ত্য জানা উদ্যমী মানুষ। রাঢ় একাডেমির জন্য স্থানীয় ডাক্তার বি. সি. মাজির কাছ থেকে তিনি খানিকটা জমি সংগ্রহ করেছেন। মূল মঞ্চ সেখানেই করা হয়েছে। সুপ্রসারিত মাঠে আরও দুটি মঞ্চ করা হয়েছে বাউল গানের শত শত শ্রোতাদের বিনোদনের জন্য। ১৯৯৫ সালে রেজিস্ট্রিকৃত এই একাডেমি বহু কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা নিয়েছেন। ভেতরে একটু আধটু দলাদলি ছিল এবং আছে— সেটা কোন সংগঠনেই বা নেই? একাডেমি এবারই প্রথম বাউল সম্মেলন করলেন। তাঁদের লিখিত বক্তব্য:
আগের তুলনায় বাউলের মর্যাদা কিছুটা ভাল। মানুষ এখন বাউলদের অন্য দৃষ্টিতে দেখে। আগে বাউলদের জীবনজীবিকা ছিল ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে সেখান থেকে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ফলে সরে এলেও বাউলদের দৈন্য সমাজের লজ্জা। আগে বেশির ভাগ বাউলদের জীবন কাটত আশ্রমবাসী হিসেবে, এখন অনেকে কেন বেশির ভাগ বাউলই গৃহবাসী। দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। খেতে-খামারে কঠোর পরিশ্রম করে বাউল সংগীতকে এঁরা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মঞ্চে হাজার হাজার মানুষের হৃদয় জয় করে যে পরমপুরুষ সে-ই আবার যখন মাঠে মাটি কাটে তখন কেউ দেখে হয়তো নাক সিঁটকোয়। কাজেই বাউলদের অভাব, অনটন, দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির সমস্যা খুবই বেদনাদায়ক। এহেন অবস্থায় সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। বাউলদের সম্মুখে সবচেয়ে বড় বিপদ হল উচ্চ শক্তি পরিচালিত মিডিয়া এবং বাউল সংগীতের উপর শহরের সংগীতের প্রভাব। এক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে দায়িত্ব নিতে হবে। সুখের বিষয় সরকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করে চলেছেন।
কাটজুড়িডাঙায় বাউল সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলবেন আশা করা যায় তবে তা যেন বাৎসরিক বাউল গানের আসরে পরিণত না হয়। একথা বলার কারণ হল, এখন পশ্চিমবঙ্গে সব জায়গায় যেসব মেলা হচ্ছে বাউলদের নিয়ে, তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনোদন।
কিন্তু হচ্ছিল সেমিনারের প্রসঙ্গ। বলা যেতে পারে, শুধু বিনোদন কই? সেমিনার কিংবা নামান্তরে আলোচনা চক্র কি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে করা হচ্ছে না? হচ্ছে, তবে কীভাবে হচ্ছে তার প্রমাণ ওই সম্মেলনেই বোঝা গেল। সেদিন মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানের কথা একটু বলা উচিত। উদ্যোক্তাদের ভাষণ, মন্ত্রী মহাশয়ের উৎসাহোদ্দীপক বক্তব্য, বিশিষ্ট অতিথিদের কথার মাঝখানে বলতে বলা হল ডাক্তারবাবুকে, যিনি রাঢ় একাডেমির জমি দান করেছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালে তিনি বললেন, ‘এখানে জমিটা পড়েছিল, এঁরা চাইলেন দিয়ে দিলাম। অন্য কাউকেও দিতে পারতাম। বাউলরা এখানে এসেছেন। এই জায়গাটা কাজে লেগেছে দেখে ভাল লাগছে। বাউল গান শুনতে ভালবাসি— তবে সব বুঝতে পারি না, কঠিন তত্ত্ব কথা। এঁদের জন্যে কিছু করা উচিত ঠিকই, একাডেমি ভাবছেন কী করা যায়। বাউলদের সমস্যার সমাধান করা দরকার। তাঁদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। আমি চিকিৎসক, আমি আর কী করতে পারি? আমার চেম্বারে এলে আমি ওঁদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে দিতে পারি। তবে এখানে বলতে আপত্তি নেই যে, এতদিন ডাক্তারি করছি, কিন্তু কোনও বাউল কোনওদিন আমার কাছে চিকিৎসার জন্যে আসেননি। ওঁদের বোধহয় রোগজ্বালা নেই। সাধক তো।’
শ্রোতারা হাততালি দিয়ে উল্লাস জানালেন, বাউলরা হাসলেন অপ্রতিভ হাসি— দেখতে পেলাম মঞ্চ থেকে। ভাবলাম, এ ধরনের অসহায় দরিদ্র মানুষদের নিয়ে এমন কথা কি আমরা বরাবর বলে যাব? বাঁকুড়া শহরের প্রসার প্রতিপত্তি সম্পন্ন ধনী চিকিৎসকের কাছে গ্রামের বাউল কি আসতে সাহস পাবে কোনওদিন? আসার কোনও স্বাভাবিক উপায় আছে কী? এলে কি সে বাউলের পোশাক পরে আসবে? নইলে বোঝা যাবে কী করে যে সে বাউল? ব্যস্ত চিকিৎসকের চেম্বারে প্রথমে নাম লেখাতে হয় এক সহকারীর কাছে। দীনবেশী গ্রাম্য অসুস্থ মানুষরা তাদের কাছে কি কখনও সদয় ব্যবহার পেয়ে থাকে? ডাক্তারবাবুর কাছ পর্যন্ত সে তো পৌঁছতেই পারবে না।
আসলে আমাদের বোঝার জায়গাটা একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বাউল যখন একতারা হাতে শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করে গান করে তখন সে একজন অন্য মানুষ— আর যখন সে গ্রামিক সমাজের অন্তর্গত থেকে বাস করে তখন সাধারণ গরিব মানুষ। আধিব্যাধিতে কি তারা আক্রান্ত হয় না? হলে কোথায় যায়? প্রথমে সহ্য করে, তারপরে টোটকা কিছু খায়। না হলে সস্তার হোমিওপ্যাথি। নিতান্ত তাতেও নিরাময় না হলে শহরে গিয়ে ফার্মেসির সেলসম্যানকে বলে আন্দাজি ওষুধ নেওয়া। ডাক্তারের ফি কোথায় পাবে? বাউলরা যে গায়— ‘এই মানুষে আছে সেই মানুষ’ — একদিক থেকে একেবারে নির্জলা সত্য। ওই সাধারণ গরিব-গুরবো, সুযোগসুবিধাহীন, অসহায় মানুষটার মধ্যে আছে আরেকটা মানুষ, সেই মানুষটা বাউল গায়। যখন গায় তখন অন্য মানুষ। সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি, নামযশ নেই, টাকাপয়সা নেই, কিন্তু মঞ্চে যখন তাকে গান গাইতে ডাকা হয় তখন তার পুনর্জন্ম হয়। সে দেখিয়ে দিতে চায় তার আসল সত্তাকে। সেটা তার অর্জিত। ওই নরম অভিমানের জায়গাটায় ঘা দেওয়া উচিত নয়।