শিল্পী জীবনে কত সুখ দুঃখের স্বাদ যে নিতে হয় তা শিল্পী না হলে বোঝা যায় না, বিশেষ করে আমাদের এই নিম্নবিত্ত ঘরে। মনে পড়ছে তিন বছর আগে রেজিনগর থানার অন্তর্গত গোপালপুর গ্রামে গান করতে যাব বলে কথা দিয়ে পঞ্চাশ টাকা অগ্রিম বায়না নিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে কালীপুজো মণ্ডপে গান। বিকেলে গান। বিকেলে গান করতে যাব, আর ঠিক দুপুরবেলায় আমার একটিই বাচ্চা— হঠাৎ কৃমির বিকারে বিষ খাওয়া রোগীর মতো ঝিঁকতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ভ্যান রিকশা করে বেলডাঙ্গা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, তখনও ঝাঁকানি চলছে। ডাক্তারবাবু কতকগুলো ইঞ্জেকশন লিখে দিয়ে বললেন, ‘সত্বর কিনে আনুন— তবে বাঁচবে কিনা জানি না।’ ঈশ্বরের নাম গুরুর কথা বারবার স্মরণ করছি শিশুর শিয়রে বসে। বার বার উচ্চারণ করি— ‘গুরুদেব তুমিই এই সন্তান দিয়েছ, রাখা বা নেওয়া তোমার ইচ্ছা।’ স্বামী-স্ত্রী হাসপাতালের নীচে বসে কাঁদছি। বিকাল ৫টাতেও অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় শুয়ে। এমন সময় আমার তিন সংগতকারী এসে হাজির গোপালপুর অনুষ্ঠান করতে যাবার জন্যে। আমি সমস্ত ঘটনা ওদের জানিয়ে বললাম, ‘গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বল আমার এই বিপদের কথা। বাচ্চা একটু সুস্থ বোধ করলেই আমি চলে যাব।’ ওরা গোপালপুর গিয়ে সব জানালে তারা কোনও কথা বিশ্বাস না করে মিথ্যা বলে দোষারোপ করে বলেছে, ‘গান গাইতে পারবে না তাই ভয়ে এল না।’ অপমানিত যন্ত্রীরা অন্ধকার রাতে তিন মাইল হেঁটে রেজিনগর স্টেশনে ট্রেন ধরে আমার কাছে রাত আড়াইটের সময় এসে বলল, ‘কাকা তোমার সন্তান বেঁচে আছে কিনা আমরা জানতে চাইছি না, তোমাকে এখুনি আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। সমস্ত যন্ত্র আটক করেছে, তুমি চল।’ ওদের কথা শুনতে শুনতে আমার জগৎসংসার টলে উঠল— সন্তান মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে হাসপাতালের বিছানায়। বুকের মধ্যে অপমান ক্ষোভ বেদনা তীব্র শোক সব তালগোল পাকিয়ে গেল। আমি আজও সেই তীব্র যন্ত্রণার কথা ভুলতে পারি না। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা শিশু— আর তার অসহায় পিতামাতার আর্তকান্না হাসপাতাল চত্বরের রাতের বাতাসকে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্বচরাচরে আমাদের কেউ নেই সেই মুহূর্তে। শোকে পাগল স্ত্রীকে হাসপাতালে একা রেখে অসহায়ভাবে ওদের সঙ্গে রওনা হলাম। আমার শিশুকে ইশ্বরের হাতে রেখে পা বাড়ালাম। স্ত্রীকে বললাম, ‘যদি আমি আমার গুরুর সঙ্গে প্রেম করে থাকি— তবে তার বিনিময়ে বলতে পারি— এই অল্প বয়সে আমায় শোক সইতে হবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি— এমন কোনও পাপ বা অন্যায় আমি করিনি যাতে আমার শিশুকে হারাতে হবে।’ স্ত্রীকে বললাম, ‘তুমি এখানে বসে বসে গুরুদেবকে স্মরণ করো, আমি চললাম গোপালপুর গান করতে।’ অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়া স্ত্রীকে একা রেখে চোখের জল মুছে গোপালপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জীবন যে কী সেদিনের মতো কি আর বুঝেছি? সারা পথ কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে শ্রান্ত পায়ে বহুদূরের রেজিনগরে নেমে আরও হেঁটে গোপালপুর পৌঁছুলাম। ওখানকার লোকগুলো আমায় দেখে নিজেদের মধ্যে বলা কওয়া করতে লাগল, ‘বিপদ-আপদ কিছুই নয়— ভাঁওতা— আসবে না বলে ডুব মেরেছিল।’ কোনও কথায় কান না দিয়ে সোজা গিয়ে জানালাম মঞ্চের শিল্পীকে নামিয়ে দিন— আমি এখুনি গান করব— বলে পোশাক পরে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কী গান গাইব? কোনও গানই মনে পড়ছে না। বারবার মনের দরজায় আছাড় খাচ্ছে শুধু আমার একমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের মুখ! গাইব কি? হঠাৎ কে যেন নাড়িয়ে দিল— সব ঝেড়ে ফেলে নিজেকে বলি ‘তুমি শিল্পী ওঠো, জাগো, গাও। জনতা অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে।’ নিজেকে সংবৃত করে গুরুবন্দনা শুরু করলাম। পরবর্তী শিল্পী যাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আমার তিনি গত সন্ধ্যায় এখানে এসে আমায় না দেখে মন্তব্য করেছেন ‘আমার সঙ্গে গাইতে পারবে না বলে নিজে আর আসেনি এদের পাঠিয়ে দিয়েছে।’ এক শিল্পীর অন্য শিল্পী সম্পর্কে যথোচিত না জেনে মন্তব্য করা যে কত মর্মান্তিক— সেদিন তা উপলব্ধি করলাম। মর্মাহত ভারাক্রান্ত চিত্তে একখানা গান মঞ্চে গেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজকের এই গানে কী পালা হবে? এবং আমার ভূমিকা কি থাকবে?’ দর্শকদের মধ্যে একজন বলল, রাধা ও বৃন্দে পালা। তুমি বৃন্দে আর উনি রাধা। আমি বৃন্দের ভূমিকায় গান গাইতে শুরু করলাম। পাঁচ ঘণ্টা গান করার পর মিলনের গান করে আসর শেষ করে পোশাক খুলেই তখনই বললাম, ‘আমার কাজ আশা করি শেষ করতে পেরেছি, এবার টাকা পয়সা যা প্রাপ্য তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিন আমি চলে যাব।’ ওরা খাবার জন্যে বলায় আমি জানালাম, ‘মুমূর্ষ সন্তান আমার হাসপাতালে পড়ে আছে। স্ত্রী একা কি করছে জানি না।’ নিজে বা যন্ত্রীরা কেউই না খেয়ে বেলডাঙা হাসপাতালে পৌঁছেই খবর নিতে, উপর থেকেই আমার স্ত্রী বলল ‘ভাল আছে। ভোর থেকে ঘুম ভেঙেই সে বাবাকে দেখার জন্যে কাঁদছে।’ আমি মনে মনে আমার গুরুদেবকে বললাম, ‘ধন্য খাজা সত্যই তুমি প্রণম্য, তোমার চরণে শতকোটি প্রণাম।’ আত্মজীবনী লিখতে বলেছেন। এই ক্ষুদ্র শিল্পীজীবনে এত ঘটনা দুর্ঘটনার ঘনঘটা, এত লৌকিক অলৌকিক ঘটনার ঘনঘটা, এত সুখ-দুঃখে দোলাদুলি যে এমন একশত খানা খাতা আর টানা দু’বছরেও বোধহয় সে লেখা শেষ হবার নয়। এই আঠারো উনিশ বছরের শিল্পী জীবনে দেখা-শোনা-জানার অভিজ্ঞতায় জীবনের থলি উপচে পড়েছে, কাকে রেখে কাকে ছাড়ি! আত্মকথা বলতে লিখতে ইচ্ছেই করে না। জীবনের ভাবনাগুলো ভাবগুলো কলমের ডগায় সে ভাবে আসে কই? আর ঘটনার ঘনঘটা সুখদুঃখের মধ্যেই কি সেই অচিন পাখিটাকে ধরা যায়? কি জানি! একজন ফকির উদাস থাকে তার প্রভুর পানে চেয়ে, কারণ হাদিস শরীফে বলেছেন— আল্লা ফারুকওয়ালা ফারুক সিন্নি অর্থাৎ আল্লা বলছেন : আমি ফকিরের ভেদ ফকির আমার ভেদ। এস্কে দিওয়ানা হয়ে প্রেমিক যখন তার প্রভুর দর্শনের পর ফানা ফিল্লাতে দাখেল হয়ে যায় আর দুই থাকে না। সম্পূর্ণ একাকার হয়ে যায়। মনে হয়, এই পার্থিব জীবনের কি ইতিহাস লিখব? যদি অনন্তকালের ইতিহাস লিখতে পারতাম তবেই লেখাটা সার্থক হত। সাধন কর্ম কলমের ডগায় লেখার চৌহদ্দিতে আসে না। রাতের অন্ধকারে ঘরে শুয়ে মানুষ যখন নিদ্রায় অভিভূত হয়ে থাকে আমি তখন আঁধার রাতে একাকী গুরুদেবের দেওয়া কাজ করে যাই। শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে দম নিতে নিতে যে ছবি ভেসে আসে সে একান্তই নিজস্ব ও গোপন।