এরপর বেশ কিছুদিন পর ওই একই বছরে আমার দীক্ষা গুরুদেব খাজা জয়নাল বাবার উর্স্ উৎসব। ১৪ই চৈত্র উৎসবে গেলাম। ওঁর শিষ্য সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার। উনি উৎসব মঞ্চে বসে বিভিন্ন শিষ্যদের ডাক দিচ্ছেন আর প্রেমিক শিষ্যদের হাতে একখানি করে লোহার চিমটি দান করছেন। কাটোয়ার একটি মেয়ের হাতে একটি ত্রিশূল দান করলেন। হিন্দুদের জন্য ত্রিশূল দেবার পর মঞ্চ থেকে উনি আমাকে ডাকলেন। প্রথম ডাকে সাড়া না দিলেও দ্বিতীয় তৃতীয় ডাকে সাড়া দিতেই হল। আমার আশংকাই সত্যি হল। আমি উঠে দাঁড়াতেই একটি লোহার ত্রিশূল হাতে নিয়ে বললেন, ‘ধর।’ দু’হাতে ধরে আছেন। আমি রাগতভাবে বললাম, ‘ওই লোহার ত্রিশূল বইতে আমি আসিনি, ওই ত্রিশূল আমার প্রয়োজন নেই।’ উনি বললেন, ‘তুমি কি নিতে এসেছ?’ আমি বললাম, ‘আমি ত্রিশূলওয়ালার সন্ধানে এসেছি।’ উনি বললেন, ‘তুমি কি ত্রিশূলওয়ালার সন্ধান আজও পাওনি? ত্রিশুলওয়ালাকে কি দেখনি তুমি?’ যখন উনি ওই কথাগুলি বলছেন তখন ওঁর দ্বিদল পদ্মে, মাকাকে মাহানুদায় এক অপূর্ব জ্যোতি ফুটে উঠেছে। রূপের কিরণ এতই তাজাল্লি ফুটে উঠেছিল তা লিখে বর্ণনা করা যায় না। আমি তখন স্বচক্ষে রূপের কিরণ প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়ে কি বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। উনি আবারও বললেন, ‘তুমি স্বয়ং মহাদেবকে কি খুঁজে পাচ্ছ না?’ আমি দেখে বলতে বাধ্য হলাম, ‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।’ ‘তা হলে তোমার সেই ত্রিশূলওয়ালা তাঁর হাতের ত্রিশূল তোমায় দান করছেন, তুমি ধর।’ আমি দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম, উনি আমার হাতে একখানি লোহার ত্রিশূল তুলে দিলেন। সারা শরীর আমার থরথর করে কাঁপতে লাগল, বুকের ভিতর যেন বহুদিনের জমাট কান্না দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার ভিতরটা যেন নিঃশব্দ চিৎকারে চৌচির হয়ে যেতে চাইছে। অথচ দু’চোখে এক ফোঁটাও জল নেই। যেন প্রবল তাপে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি বুকে নিয়ে ত্রিশূল ওঁর পায়ের কাছে রেখে আভূমি প্রণাম করে আবার ত্রিশূল হাতে টলতে টলতে ভূতগ্রস্ত এক মানুষের মতো স্খলিত চরণে মঞ্চ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম। হঠাৎ দেখি আমার গানের দ্বিতীয় গুরু ডাঃ একরামূল হক আমার পাশে এসে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘তোমার কি হয়েছে? অমন করছ কেন? আমি তোমার পাশে আছি তো। গুরুদেব তোমার পরিশ্রমের পুরস্কার দিয়েছেন এ তো পরম গৌরব ও গর্বের। তোমার অর্জনের প্রমাণপত্র দিয়েছেন। তুমি গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়ে তাঁর কর্ম তুমি করেছ। তাই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে একটি জায়গায় পৌঁছে দিলেন।’ আমি বললাম, ‘আমি এ নিয়ে বাড়ি যাব না, আমি তো দেখেছি ত্রিশূল চিমটি নিয়ে সকলে রাস্তায় রাস্তায় উদাসী হয়ে ভিখারির মতো ঘুরে বেড়ায়।’ আমার জানা চিমটি দু’রকম একটি লোহার অপরটি চামড়ার। চামড়ার বলতে গোল স্ত্রীদ্বারের আকৃতি ও কিছুটা ত্রিশূলের মতো। তা হলে ত্রিশূল নিয়ে বেড়াতে হলে আর সংসার ধর্ম করতে পারব না। সবাই আমাকে ভণ্ড বলবে, কারণ হাতে ত্রিশূল মাথায় চুল মুখে দাড়ি। এদিকে সন্ধে হলে বউ-এর কাছে যাওয়া বা স্ত্রীসংসর্গ করা সম্ভব নয়। এতে মানসিক চাপ তৈরি হয়। এই ধরনের বিপরীত আচরণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হল। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তুমি নিয়ে গিয়ে রাখো তো, পরে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে তোমায় বলছ— তোমায় কি করতে হবে।’ এরপর সকালবেলায় খাজা বাবা ডাক দিলেন, সামনে পায়ের কাছে বসতেই উনি একটি লাল সুতির কাপড় আমার মাথায় পাগড়িস্বরূপ বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘তোমার গুরুদেব যা দিয়েছেন তুমি তার ভক্তি রাখবে এবং এখন সংসারধর্ম পালন করবে। যখন প্রয়োজন মনে করব তখন তোমায় সংসার থেকে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট কর্মের মধ্যে পাঠাব।’ আমি দরবার থেকে ত্রিশূল হাতে না নিয়ে চলে আসব মনস্থির করলাম। দেখছি আমার গানের দ্বিতীয় গুরুদেব ডাঃ একরামূল হক ত্রিশূলটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, বললেন, ‘ধর, নিয়ে চল।’ তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে উনি নিজে হাতে বহন করে বেলডাঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে এসে আমার দিয়ে বললেন, ‘তুমি সোজা বাড়ি গিয়ে একটা পরিষ্কার জায়গায় রেখে দাও এবং প্রত্যহ এতে তেল জল দেবে ও একে ভক্তি করবে।’
মাথায় পাগড়ি ও ত্রিশূল আজও পবিত্র জায়গায় রেখে দিয়ে ভক্তি করে চলেছি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় আমার দীক্ষা গুরুদেব উর্স্ উৎসব করতে যেতেন আমরাও সঙ্গে যেতাম। সেই প্যান্ডেলে আমাকে সেজরা শরীফ পাঠ, ইসলামিক গজল, নাত ও ফকিরি, মারফতি, আধ্যাত্মিক গান করার নির্দেশ করলে আমি পরিবেশন করতাম। ইনি আমাকে একটি কাজ করতে নির্দেশ দিলেন। কাজটি হল : রাত্রে একা নিরালায় নিভৃতে বসে সেজরা শরীফ পাঠ এবং স্মরণের মাধ্যমে দর্শন জিকির প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে গুরু বর্জক সামনে ভাসিয়ে আপনাকে মিশে ফানা হয়ে যাওয়া এবং দেখতে হবে বা দেখা যাবে (আমিই গুরু গুরুই আমি)। এই বিশ্বব্যাপী আমাকে ছড়িয়ে দেওয়া বা আমিই ছড়িয়ে যাওয়া।
আমি বিভিন্ন মেলায় গিয়েছি যেমন বৈরাগ্যতলার মেলা, পাথরচাপুড়ির মেলা, কল্যাণী ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলা, অগ্রদ্বীপধামের মেলা এবং বিভিন্ন পির মাজার বা পির সাহেবের দরবার। তবে আমার সমস্ত দেহ সত্তার আড়ালে বসে একটি অমোঘ শক্তি কাজ করে। সেটি হল পরম করুণাময়, আরাধ্য জামানায়ে আরেফ বিল্লা হজরত শাহ সুফি খাজা জয়নাল আবেদিন আল চিশতি (রহঃ)। বিভিন্ন গ্রামে বাউল মেলায় ইসলামিয়া গান পরিবেশন করার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে থাকি। ওখানকার মানুষ আমার নামে প্রচারপত্র ছাপলে আমার পদবি বা নানা বিশেষণ দেন— যতীন হাজরা ফকির ইসলামিয়া তত্ত্ববিশারদ অথবা ইসলাম তত্ত্বের জাহাজ…ইত্যাদি। আমার নামের পাশে কোন বিশেষণ সাজাচ্ছে এটা আমার কাছে গর্ব বা অহংকারের কথা নয়। কিন্তু ওইসব বিশেষণের উপযুক্ত কাজ করে প্রমাণ করতে পারব কিনা— অথবা এই মর্যাদা বহন যাতে করতে পারি সেই চিন্তাতেই আকুল হয়ে উঠি। বিভিন্ন বাউল মেলাতে গান করতে গেলে মুসলিম শ্রোতারা নানা ইসলামিয়া প্রশ্ন করেন এবং সব প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক উত্তর আমি দিতে চেষ্টা করি। বাল্যকাল থেকে যে শিক্ষাগুলি আয়ত্ত করেছি সেগুলি সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে পেরে ভাল লাগে। বাংলাদেশের একজন হাফেজ সাহেবের মাধ্যমে কোরান শরীফ বাংলা উচ্চারণ, বাংলা ব্যাখ্যা, তর্জমা করা আনিয়ে নিলাম। এটির তর্জমাকারী মৌলানা মাজাহারউদ্দিন সাহেব। আমি হিন্দু মুসলমান জানি না— আমি জানি আমি একজন শিল্পী। জানা বা শিক্ষার তাগিদে গানের মর্মভেদ করতে আমাকে প্রয়োজনীয় শাস্ত্র বা তত্ত্ব জানতেই হবে। মোটকথা এই মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ালে ছোট-বড় কালো-ধলো হাড়ি-মুচি, মেথর-ব্রাহ্মণ, উঁচু-নিচু বিভেদ দেখা যায়। কিন্তু একটি বিমানে চেপে শূন্য আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানোর সময় উপর থেকে নীচের মানুষগুলোকে ছোট ছোট দেখায়— যত উপরে ওঠা যায় নীচের দৃশ্যাবলি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয় এবং বহু উপরে উঠলে একটা সময়ে নীচের দূরের সবকিছুই অস্পষ্ট, ঝাপসা কুয়াশাচ্ছন্ন ও একাকার মনে হয়। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। গুরু নির্দেশিত পথপরিক্রমায় যিনি সিদ্ধ, তাঁর দৃষ্টি বিমানবিহারীর মতোই সমদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে যায়। তখন জাতি ধর্ম বর্ণ কুসংস্কারের ধোঁয়া ছায়া মানুষের দৃষ্টিকে আর আবিল ও অস্পষ্ট রাখে না। ‘মান’ ও ‘হুঁস’ সম্পন্ন ব্যক্তিই তো মানুষ। মান-মর্যাদা-বিবেক চালিত হয়ে পশুশক্তি থেকে জ্ঞান ও প্রেমের জগতে উঠতে পারলে মনুষ্যত্ব জাগে পরিপূর্ণরূপে। প্রেমের জগৎটি অবশ্য আর একটু এগোনো। বাহির জগতের কর্মচিন্তা সামাজিকতা এগুলি বেঁচে থাকার মাপকাঠি মাত্র। কিন্তু অন্তরে ভালবাসা যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তার দর্শন বা মিলন না হওয়া পর্যন্ত কুরে কুরে খায়। তাই তো প্রেম করো তুমি তোমার প্রভুর সঙ্গে যিনি প্রেম আস্বাদন করার জন্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এই নিখিল বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে দিয়েই স্রষ্টা নিজেকে আস্বাদন করতে চেয়েছেন। যে প্রেমের চূড়ান্ত পর্যায় মিলন — চোখের জল ফেল এইভাবে—-সে জল অন্য কেউ যেন না দেখে। তোমার চোখের জল অন্য কেউ দেখলে মাঝখানে দেওয়াল সৃষ্টি হবে। নিরালা নিভৃতে গোপনে চুরি করে প্রভুকে স্মরণ করে ভক্তির মাধ্যমে সেজদায় অবনত হয়ে চোখের জল ছেড়ে দাও। ভেসে যাক তোমার জায়নামাজ, ভিজে যাক তোমার আসন, অন্তরের কান্নার সুর যেন অন্য কারও কানে না পৌঁছয়। জেনে রেখো তোমার প্রভু দরজা খুলে অধীর আগ্রহে কান পেতে বসে আছে। সারাদিন শুধু কর্মের মাধ্যমে দিন কাটিয়ে দিয়ো না। অন্তরের গোপন চিলেকোঠায় সেই ছবিকে বসিয়ে রাখো, যে ছবি গুরুদীক্ষার সময় তোমায় দেখিয়ে ছিল, ওই ছবিই চিরসত্য, চির অম্লান, চলমান জীবনের পথ এবং পরপারের কান্ডারি। পিরের সঙ্গে প্রেম করে যে জ্ঞান গরিমা দয়া করে দান করেছেন সময় সংকীর্ণতার মধ্যে তার কিঞ্চিৎমাত্র ইশারা দিলাম।