আমি আমন্ত্রণপত্রটি হাতে নিয়ে বাড়ি এসে প্রথমে আমার প্রথম গুরু জাফরউদ্দিন সাহেবকে দেখালাম। উনি দেখে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোকে বলেছিলাম না, তুই অনেকদূর যাবি। আমার আশীর্বাদ বিফলে যাবে না, জিন্দেগীভর তেমন কিছু করতে না পারলেও আল্লার জিকির আমি কোনও দিন কাজ করিনি। তিনার এই আত্মবিশ্বাস আমার মনের জোর বাড়িয়ে তুলত।’ কার্ডখানি নিয়ে চললাম আমার দ্বিতীয় গুরুদেব ডাঃ একরামুল হকের কাছে। উনি আমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি জয়ী হবে এবং সুসম্মান বহন করে আনবে।’ সকলের আশীর্বাদ নিয়ে সেই অচেনা জেলায় চললাম। রাস্তা অনুযায়ী সকালে বেরিয়ে খুঁজে খুঁজে গিয়ে পৌঁছুলাম উত্তর দিনাজপুর জেলার সুভাষগঞ্জ গ্রামে। সবই যেন অচেনা অপরিচিত। একা একা নির্বোধের মতো খানিকটা অসহায়ের মতো অফিসে দেখা করে নাম লিখে দিলাম। তারপরে একজন আমায় সঙ্গে নিয়ে একটা বড় চাঁচমহল ঘরে থাকা শোবার জায়গা দেখিয়ে দিল। আমি বিছানা পেতে বিশ্রাম করতে লাগলাম, আর উৎকণ্ঠিতভাবে আসরের ডাকের অপেক্ষায় সময় গুনতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তরণীদার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। উনি বললেন, ‘আজ আপনার আসর দিচ্ছি না, আজ বিশ্রাম করুন। আগামীকাল, বৈকাল ৪-৬টার সময় মনসুর ফকিরের সঙ্গে আপনাকে মঞ্চে পাঠাব।’ মনসুর ফকিরের নামও জানা নেই, ভাবনা শুরু হল। উনি আমাকে কেমনভাবে সঙ্গে নেবেন, কি ধরনের শিল্পী, কি গান গাইবেন, আমি ওঁর পাশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গান গাইতে পারব কিনা— এই সব সাত-পাঁচ ভেবে অস্থির হলাম। তারপর বিকেল ৪ টের আগেই মঞ্চে উঠে বসলাম, সঙ্গে মনসুর ফকির নিজেই মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে গান শুরু করলেন। আমি নীচে বসে থাকলাম। উনি পরপর সাতখানা গান করে বসলেন। শেষ গান গাইলেন, ‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়/ রূপকাষ্ঠের নৌকাখানি নাই ডোবার ভয়।’ লালন ফকিরের গানখানি গেয়ে বসলেন। আমার মনে হল আমাকে উনি পরীক্ষা করার জন্য এই গানখানি গাইলেন। আমি ঘড়িতে দেখছি ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় কেটে গিয়েছে। তারপর তরণীদার ইঙ্গিতে মঞ্চে গান গাইতে উঠলাম। মনসুরের গানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম গান আরম্ভ করলাম : ‘যারে বলি নবী নবী তাহার তত্ত্ব পেলাম না/ নূর নবীকে চিনলে পরে চিনা যায় পরুয়ারে/ সারুয়ারে বলেছে বেনা নূর নবীজির আইন ধরে চলেছিল চার ইয়ারে/ শেযেতে কুরনি শহরে আলির সঙ্গে হয় জানা/’ এরপর মনসুর আর নিজে না উঠে ওঁর এক সঙ্গীকে গান করতে মঞ্চে পাঠালেন। একটি গান আমার গানের পরিপ্রেক্ষিতে গাইলেন, তবে আমার গানের জবাব হল না বলে আমার মনে হল। আমি পরে দ্বিতীয় গান নবীস্তুতিই গাইলাম। সে গানের যে জবাব হওয়া দরকার সেটাও হল না। এই চার পাঁচখানা গান গাইবার পর সময়ও শেষ। ওরা সকলেই উঠে মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেল। আমি আমার ডুগি একতারা নিয়ে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পেছন থেকে আমারে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। পিছন ফিরেই দেখে তরণীসেন মহান্ত আমায় জড়িয়ে ধরে বিশাল গর্ব ও আনন্দভরা মুখে মাইক্রোফনের সামনে আমাকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ইনিই সেই যতীন হাজরা, যাঁকে আমি অর্জুনপুর হাইস্কুলে রাজ্য বাউল ফকির সম্মেলনে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একজন সুদক্ষ সুকণ্ঠ প্রকৃত জাত-ফকির বলে শনাক্ত করে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলাম। এখনকার কমিটি হয়তো এঁর সংগীত প্রতিভা সম্যক উপলব্ধি করতে না পেরে এঁকে প্রথমত ফকির শিল্পী বলে মনে করছিলেন না। ইনিই সেই যতীন হাজরা— যাঁকে মঞ্চে না ওঠালে তাঁর জাত চেনা যায় না। যতীনদা অপূর্ব হয়েছে আপনার আসর। কমিটি তথা দর্শকবৃন্দ সকলেই ধন্য।’ আমি মনে মনে আমার গুরুদেবদের প্রণাম জানালাম। আজ এখানে পৌঁছে দিয়েছেন তো তাঁরাই। তাঁদের আশীর্বাদ ও প্রেরণাই আমার পরম পাথেয়। ওই অনুষ্ঠান শেষে চারদিন পর বাড়ি ফিরলাম এবং ওখানকার সমস্ত খবর গুরুদেবদের জানাতেই ওঁরা যে কী খুশি হলেন— তা বর্ণনা করা আমার ভাষাতীত। কিছু দিন পর মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক বাড়িতে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। উনি— মদনমোহন দাস মহাশয় জানিয়েছেন কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে সর্বভারতীয় লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান হবে। বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পী সমন্বয়ে এই অনুষ্ঠান হবে। শিল্পীদের সল্টলেক স্টেডিয়ামে থাকার ব্যবস্থা। পরদিন বেলডাঙা স্টেশন থেকে তিনজন শিল্পী সঙ্গীকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। যথাসময়ে শিয়ালদা স্টেশনে নেমে অনেক রাতে অটো রিকশায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে পৌঁছুলাম। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় একমাত্র মদনবাবুর চিঠিই ভরসা। চিঠিটা এক ভদ্রলোককে দেখাতেই উনি আমাদের ভিতরে অফিসে নিয়ে গেলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন। এমন পরিবেশে নিজেকে দেখে কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেলাম। নিজেরই আজান্তে চোখে জল ভরে এল, গুরুদেবের গভীর আশীর্বাদ ও শিক্ষা ছাড়া এই জায়গায় কি আমি পৌঁছুতে পারতাম! তারপর দুপুরে খাওয়া সেরে বিকেল তিনটের মধ্যে পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে লাক্সারি বাসে চেপে রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমরা রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম বিশাল মঞ্চ, প্রথমেই আমাদের সম্প্রদায় সম্প্রীতির উপর ভিত্তি করে গান পরিবেশন করতে নির্দেশ দিলেন। মঞ্চে উঠে প্রথমেই এই গানটি গাইলাম : ‘শোন গো বিশ্ববাসীগণ মানুষ হইয়া করো সবে মানুষের পূজন/ এই ভারতবর্ষ মোদের কাছে শান্তিনিকেতন।’ গানখানি করে মঞ্চ থেমে নেমে আসতেই দেখতে পেলাম, লম্বা দোহারা শরীর বাউল পোশাকে সজিত একজন বাউল শিল্পী, দেখে যেন চেনা মনে হচ্ছে। আমাকে দেখে উনি বললেন, ‘কোথায় বাড়ি তোর?’ আমি বললাম, ‘মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গা থানা, আমার নাম যতীন হাজরা।’ উনি আমাকে বললেন, ‘আমাকে চিনিস না? আমার নাম প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী। আমাকে টি. ভি-তে দেখতে পাস না? আমি বাড়ি ছিলাম না— কাল আমেরিকা থেকে বাড়ি ফিরেছি। এরা বলল তাই না এসে পরলাম না।’ মনে ভাবলাম এত সাধের জৌলুস-এর একখানা গান না শুনে যাব না এখান থেকে। আমার পরে একঘণ্টা ধরে কবিগান হল, তারপর যথাক্রমে নেপালি গান, গুজরাটি গান, সাঁওতালি গান হল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীদের রেকর্ডকৃত গানের সঙ্গে নাচ দেখলাম। শেষে ওই শিল্পী মানে প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী মঞ্চে উঠলেন। বেশ আগ্রহ নিয়ে মঞ্চের পাশে দাঁড়ালাম। উনি দু’পাশে তিনজন করে ছ’জন যন্ত্রী বসালেন তারপর মাঝখানে বসে একখানি গান শুরু করলেন। লালনের অতি বিখ্যাত গান ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ একটি অতি পরিচিত সাধারণ সুরে গানটি গাইতে দেখে মনে মনে ভাবলাম ইনিই আমেরিকা-রাশিয়া-জাপান ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং ছ’জন যন্ত্ৰী সংগত করছেন, আর আমাকে ডেকেছেন দু’জন শিল্পী ও একজন যন্ত্রী নিয়ে। এতে নিজে বাজিয়ে কি গাইব? আর তার মর্যাদা কে দেবে? যাই হোক অনুষ্ঠান শেষে আবার বাসে করে সল্টলেক স্টেডিয়ামে নিয়ে এলেন। তারপর ওঁরা বললেন, ‘লালগোলা যাবার ট্রেন ১০-৫৫ মিনিটে। আপনি কি ওই গাড়িতে যেতে চান?’ আমি জানালাম আর কোনও অনুষ্ঠান না থাকলে বাড়িই যাব। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে প্রস্তুত হয়ে বের হওয়ার মুখে আমার হাতে ওঁরা ২৭০.০০ টাকা দিলেন। আমি কেমন অভিভূত হয়ে গেলাম। গ্রামের সামান্য মানুষ— এতগুলো মানুষের সামনে গান করেই নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম।