তখন সংসার জীবনে বিড়ির ব্যাবসা করতাম। শ্রমিক ছিল তেরো জন। নদিয়া জেলার পলশুড়া, বারুইপাড়া গ্রামে বিভিন্ন দোকানে হকারি করে মাল দিয়ে বেড়াতাম সপ্তাহে দু’দিন। আর যে-কোনও সময়ে কোনও গ্রাম থেকে গানের বায়না পেলে ব্যবসায়ে না গিয়ে গান করতে যেতাম। কারণ যেদিন থেকে গানের দিকে নজর দিলাম তখন থেকে গানই আমার কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠল যে গান গাইতে কেউ নিষেধ করলে বা আমার গানের বিরোধিতা করলে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হত। সে যতই প্রিয় হোক না কেন মুখের সামনে তাকে অপমান করতে দ্বিধা কসুর করতাম না। এখনও পর্যন্ত গানের জগৎ সম্পর্কে কেউ কটাক্ষ করলে এতই ক্ষুব্ধ হই যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। কয়েকদিন আগে একজন মৌলবি এসে বলল, ‘দাদা আপনার মুখে দাড়ি ঠিক আছে কিন্তু গোঁফ যা রেখেছেন সামনের ক’টা ছেঁটে ছোট করে রাখলে ভাল হয়।’ মৌলবির প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আপনার ওই পর্যন্ত শিক্ষা হয়েছে, তবে ওই শিক্ষাতে ওই তত্ত্ব বুঝতে পারবেন না, প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রকে কলেজের শিক্ষা বললেও বুঝতে পারবে না। কারণ তার মাথায় তেমন বোঝার মতো মগজ তৈরি হয়নি।’
সাম্প্রতিক কালে সরকারের আনুকূল্যে সার্বিক সাক্ষরতার কাজ শুরু হয়েছে। বাড়ির সামনে পঞ্চায়েত মিটিং এর আয়োজন সকাল থেকে চলছে। একটা প্রাইমারি স্কুল চত্বরে এটা হচ্ছে। হঠাৎ সেক্রেটারি সাহেব এসে বললেন, ‘যতীন, আজ আমাদের এখানে মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক দপ্তর থেকে বিভিন্ন সাক্ষরতা ভিত্তিক নাটক, বাউলগান পরিবেশন করা হবে। তুমিও তো বাউল গান করো— মঞ্চে ২/৪ খানা গান গাইলে হত না।’ আমি বললাম, ‘সাক্ষরতার গান কেমন হবে আমার তো তেমন কোনও গান জানা নেই।’ উনি বললেন, ‘মানুষকে লেখাপড়া শেখার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা, অর্থাৎ উৎসাহ জোগানো— এমন কিছু গান তোমায় গাইতে হবে।’ বাড়ি গিয়ে বসে কলম ধরে পরপর চারখানা গান লিখলাম। তারপর সন্ধ্যায় মঞ্চে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে ওই গান গাইতে লাগলাম। লক্ষ করে দেখেছি, মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। গান শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই উনি বললেন, ‘তুমি এত সুন্দর গান করতে পারো, তা আমাদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করনি কেন?’ আমি বললাম, ‘কারও কাছে তেলিয়ে বলাটা আমি পছন্দ করি না। দুটো গান শিখে বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিয়ে বলে বেড়াব আমি একজন শিল্পী আমাকে প্রোগ্রাম দিন, ডাকুন গোছের কথা বলে বেড়ানো আমার পেশা নয়, আমি গরিব হতে পারি তবে ভিখিরি নই। গাছের বিচার ফলে। আমি যে কী শিল্পী কেমন শিল্পী সেটা বিচার হবে আমার গানে বা জ্ঞানে। গুরুদেব দয়া করে যে শিক্ষা দিয়েছেন, যা শিখিয়েছেন, ঝোলার মধ্যে পুরে নিয়ে ঘুরে বেড়াব, নিশ্চয় জ্ঞানীর বাজার কোথাও না কোথাও মিলবে সেখানে নিশ্চয়ই আমি মর্যাদা পাব।’ তারপর মদনমোহনবাবু বললেন, ‘আগামীকাল মির্জাপুর গ্রামে অনুষ্ঠান হবে, তুমি সন্ধ্যায় তোমার যন্ত্রসঙ্গীসহ গিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেবে।’ আমার শুনে মনে বড়ই আনন্দ হল। পরদিন মির্জাপুর যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি আর আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। সঙ্গীরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে এই মেঘ মাথায় নিয়ে কীভাবে রওনা হবে? আমি তাদের সংশয় দেখে বললাম, ‘জীবনে প্রথম সরকারি বাবুরা ডেকেছেন, যত কষ্ট বা বাধা আসুক না কেন আমরা যাবই। নিশ্চয়ই গুরুদেবের আশীর্বাদ আমার সঙ্গে থাকবে সর্বদা, তাঁর আশীর্বাদ আমার মাথায় ছাতার মতো আচ্ছাদিত হয়ে আমার রক্ষা করবে— দেখো বৃষ্টি হবে না।’ সবাই আমরা নির্বিঘ্নে মির্জাপুর পৌঁছুলাম। মদনমোহনবাবু বরুণবাবু আমাদের দেখে সন্তুষ্ট হয়ে প্রথমেই আসরে আমাদের গান গাইবার সুযোগ দিলেন। গুরুদেবকে স্মরণ করে মঞ্চে উঠতেই মির্জাপুরের মানুষ বিশেষ করে মুসলিম পল্লিতে আমার নাম ডাক আছে ইসলামি গান করার জন্য— আমাকে দেখে বা যাওয়া দেখে আরও বেশি জনসমাগম হল সেদিন। গান পরপর সাত আটখানা গাইলাম। গানের সবাই খুব প্রশংসা করল। গানের শেষে ভাল মিষ্টি পাউরুটি খাওয়াল। রাতে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। ওই প্রথম মদনমোহনবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। এর কিছুদিন পর আমার বাড়িতে চিঠি এল একটি। সেই চিঠিতে জানলাম ফারাক্কার অর্জুনপুর হাইস্কুলে বাউল ফকির রাজ্যসম্মেলন হবে। দু’জনকে ডেকেছে। চিঠিটা নিয়ে গিয়ে ওস্তাদ জাফরউদ্দিন ও গোঁসাই মদনদাস বৈরাগ্য ও ডাঃ একরামূল হককে দেখালাম। ওঁরা দেখে খুব খুশি হলেন এবং আশীর্বাদ করলেন। ওঁদের ও বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে চললাম আমরা অর্জনপুর হাইস্কুলের সম্মেলনে। গিয়ে দেখলাম অজস্র নামী দামি শিল্পীর জমায়েত। এঁদের মধ্যে আমি কীই বা গাইব এই সব নানা চিন্তা করছি। বাউলের পোশাক তৈরি করানো হয়েছিল। প্রথম দিন সকালে পোশাক পরে নগর পরিভ্রমণ করে রেললাইনের পাশে একটি বাগানে মঞ্চে জমায়েত হলাম এবং প্রথম দিন একটি গান পরিবেশন করার জন্যে নাম লিখে দিলাম, বৈকাল তিনটে থেকে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসে থেকে একটি গান করারও সুযোগ হল না। তখন শেষে স্কুলে ফিরে এসে পোশাক খুলে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিন আবার বিকালে, তিনটার সময়ে পোশাক পরে মঞ্চের পাশে হাজির হলাম, দেখছি প্রতিটি শিল্পী একখানা করে গান পরিবেশন করার সুযোগ পাচ্ছে। আমি ওইদিন রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসে থেকে একটিও গান করার সুযোগ পেলাম না। রাতে স্কুলে এসে পোশাক খুলে খেতে যেতে আর মন চাইছে না। বারবারই মনে হচ্ছিল সেই কাপাসডাঙা থেকে এই অর্জুনপুর সম্মেলনে এসে একটি গান গাওয়ারও কি সুযোগ হবে না? বাড়ি ফিরে গিয়ে যখন গুরুদেব জিজ্ঞাসা করবেন, কোন গানটা গাইলাম, আমি কি জবাব দেব? এখানে কি শুধু খেতে আর পয়সা নিতে এসেছি? নিজেকে নানা প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকলাম। মনে হল— না এভাবে তো চলতে পারে না। এইভাবে তৃতীয় দিন এল এদিনও পোশাক পরে মঞ্চের পাশে আবার এসে দাঁড়ালাম, নিজের নাম লিখিয়ে ডাকের অপেক্ষায় রইলাম। এই দিনই শেষ দিন— তাই অধীর আগ্রহে ও উৎকণ্ঠায় সময় পার হতে লাগল। তারপর রাত্রি আটটার কাছাকাছি আমি অধৈর্য হয়ে বরুণবাবুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘একটি গানও গাইবার সুযোগ পেলাম না— এই ক’দিনে— গানই যদি না গাইব তা হলে কেন এখানে এসে তিনদিন হত্যে দিয়ে পড়ে আছি? কেন আসতে বললেন এখানে?’ উনি বললেন, ‘তুমি এখনও গাইতে পাওনি?’ আমি বললাম, ‘সুযোগ কোথায়? আপনারা তো নামী দামি বেতার ও দূরদর্শন শিল্পী নিয়েই মহাব্যস্ত।’ উনি বললেন, ‘যাও আমি তোমার নাম প্রচার করছি, যাও মঞ্চে যাও।’ আমি বললাম, ‘আমি একা কি করে যাব— আমার সঙ্গে আরও তিনজন শিল্পী এসেছেন— আমার সঙ্গে তাঁদের নামও প্রচার করুন। সঙ্গত করার জন্য এই তিনজন শিল্পী ছাড়া গান তো শ্রীহীন হবে। কেউ বাঁশি বাজাবে— কেউ হারমোনিয়াম কেউ তবলা বাজাবে— তবেই অখণ্ড গানের মেজাজ ফুটবে।’ উনি চারজনের নামই প্রচার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মঞ্চে উঠে গেলাম। মঞ্চে উঠে সঙ্গের তিনজনকে আগে গান করে নিতে বললাম। ওদের তিনখানা গান শেষ হবার পর আমি বসে বসে ভাবছি— এই মঞ্চে বিভিন্ন নামী দামি শিল্পীরা তো সাক্ষরতা, সম্প্রদায়-সম্প্রীতির গান গেয়ে গেছেন— আমি কী গানই বা গাইব। মনে মনে গুরুদেবদের স্মরণ করে ভাবছি— এখন দর্শকবৃন্দ যা আছেন বিশেষ করে শতকরা সত্তর ভাগই মুসলমান— তা হলে ইসলামিয়া গান পরিবেশন করে দেখি না কেমন সাড়া জাগে। এই ভেবে মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বলেছিলাম, ‘উপস্থিত সুধী শ্রদ্ধেয় দর্শকবৃন্দ ও আমার শিল্পীবন্ধুগণ— প্রথমে আপনাদের সকলকে আমার প্রণাম, নমস্কার ও স্নেহময় আশীর্বাদ জানিয়ে দু’-একটি কথা বলি। আমি কোনও বেতার-দূরদর্শন বা বিদেশ ভ্রমণকারী শিল্পী নই। এই গ্রামের মাঠে ঘাটে পল্লিতে ঘুরে বেড়ান একজন নগণ্য শিল্পী। গানের ভাষার সুর, তাল অবশ্যই ভুল হতে পারে, তাই সকলের কাছে প্রার্থনা, অধম মনে করে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। —এই বলে এই গান শুরু করলাম, ‘নবীকে চেনা হল না/ যারে বলি নবী নবী, তাহার তত্ত্ব পেলাম না।’ গানখানি আমি তো মঞ্চে গাইছি এবং নাচছি— এর ফাঁকে লক্ষ করে দেখছি দর্শকবৃন্দের অনেকে মাথায় চাদর গামছা বেঁধে আমার তালে তালে ওরাও নাচছে। গেটের কাছে আট/ দশজন মানুষ দাঁড়িয়ে— ওরা সবাই সমস্বরে বলছে ‘থামাথামি নেই চালিয়ে যান।’ গান শেষ হতে না হতে ফারাক্কার এম. এল. এ হাসানুজ্জামান সাহেব মঞ্চের নীচে সামনে এসে বলছেন, ‘যতীনদা আপনি চালিয়ে যান।’ গেটের সামনে লোকের ভিড় দেখে প্রথমে ভয় হয়েছিল— ভাবছিলাম হয় তো গানে কোনও ভুলচুক হয়েছে আমার ঝামেলা করবে ওরা। পরে বুঝলাম আমার গানে খুশি হয়ে ওরা আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। আমিও উদ্দীপ্ত হয়ে আর একখানা গান ধরলাম। এ গান রজ্জব দেওয়ানের লেখা ‘তারে ধরতে কয়জন পারে, তারে চিনতে কয়জন পারে/ পঞ্চরসে রাখাল বেশে ফুটল আবদুল্লার ঘরে/ ধরতে কয়জন পারে চিনতে কয়জন পারে।’ দ্বিতীয় গানটা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে চাইলাম। গেটের কাছে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা বাধা দিল। আরও অনেক শিল্পী গাইতে বাকি ছিল তাই সবাই বাধা দেওয়া সত্ত্বেও নেমে এলাম। দর্শক-বৃন্দকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বরুণবাবু বললেন, ‘অনেক শিল্পী এখনও গাইবার জন্যে অপেক্ষা করছেন তাঁদের গান হয়ে গেলে যতীন হাজরা আবার মঞ্চে উঠে গান করবেন।’ আমি মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই বরুণবাবু আমায় বললেন, ‘তুমি এক্ষুনি স্কুলে গিয়ে শুয়ে পড়। যাবার সময় ওদের বলে যাও একটু পরেই ফিরে আসবে।’ যাই হোক প্রায় চোরের মতো চুপি চুপি লুকিয়ে স্কুলে পালিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে অনুষ্ঠান সেরে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সময় অনেক লোক আমার ঠিকানা লিখে নিয়েছিল। মঞ্চ থেকে গান গেয়ে নেমে এসে একটু ভোরের দিকে আমি যে ঘরে থাকতাম ওই ঘরের এক পাশে আর একজন শিল্পীবন্ধু ছিলেন। ওঁর পরিচয় আমার তেমন কিছু জানা হয়নি। তবে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ উনি বললেন, ‘আমার বাড়ি উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে নেমে সুভাষগঞ্জ গ্রাম।’ ঠিক ভোরবেলায় উনি আমায় এসে বললেন, ‘দাদা আপনার সঙ্গে কথা আছে, আমার এখানে আসুন।’ আমি উঠে ওঁর বিছানার পাশে বসলাম। দেখতে ভারী সুদর্শন মানুষ। মাথায় বড় বড় চুল উপর থেকে যেন কোঁচকানো, কাজলকালো দুটি আয়ত দীর্ঘ চোখ গায়ের রং কৃষ্ণের মতো কালো। একবাক্যে শ্রীকৃষ্ণ বললে ভুল হবে না। অতি শান্ত নম্র ধীর ভাব মনের মধ্যে কোনও অহংকার আছে বলে মনে হল না, তবে গর্ব আছে। পাশে এসে বললাম, ‘বলুন কি বলবেন?’ উনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন— তারপর ঠিকানা। আমি আমার নাম ঠিকানা বলতেই উনি একটি খাতা বের করে লিখে নিলেন। তারপর একটি কার্ড বের করে পথ নির্দেশ লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আপনি পয়লা বৈশাখ আমার বাড়ি আসুন পথ খরচা ও সাম্মানিক দক্ষিণা অবশ্যই দেওয়া হবে।’ কার্ডে লেখা ছিল ওঁর নাম : তরণীসেন মহান্ত।