তাঁর নির্দেশমতো আমি বাবা-মায়ের কাছে সব কথা খুলে বললাম, একজন শিল্পীর পক্ষে জাতধর্ম মেনে সত্যিকারের শিল্পী হওয়া যায় না। শিল্পীকে তার সিদ্ধির স্তরে পৌঁছুতে হলে জাতের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে বদ্ধ করে রাখলে সকলের জন্যে গান কীভাবে উঠে আসবে আমার শিল্পী চেতনায়? বাবা-মা বুঝলেন আমার বেদনা ও সমস্যা। তাঁরা আমাকে আমার বিবেক অনুযায়ী চলার নির্দেশ ও পরামর্শ দিলেন। বংশের বড় ছেলে বলে আমার করণীয় কর্তব্যের কথাও মনে রাখতে পরামর্শ দিলেন। দু’-চারদিন দারুণ ভাবনার মধ্যে কাটিয়ে অবশেষে সব সংকোচ, সংস্কার ও ক্ষুদ্রতার গণ্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করে অথচ বংশ মর্যাদার পক্ষে হানিকর এমন কোনও কাজ না করার শপথ নিয়ে পিরবাবার শরণাপন্ন হবার সংকল্পে অটল হলাম। আটমাস পর ওই পিরবাবা বেলডাঙা থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে উর্স্ উপলক্ষে এলেন। পিরবাবার নাম হল— জমানায়ে আয়েফবিল্লা হজরত শাহ,, সুফি খাজা জয়নাল আবেদিন আল চিশতি (রহঃ)। উনি এলে ওঁর ভক্তদের কাছে খবর পেয়ে গানের সূত্র ধরেই ওঁর কাছে গেলাম। সন্ধ্যায় গান শেষ হল। রাত তিনটের সময় আমার দ্বিতীয় ওস্তাদ ডাঃ একরামূল হক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ওঁর কাছে। সামনে বসে সানুনয়ে বললাম, ‘বাবা আপনার কাছে দীক্ষা নিতে চাই।’ উনি আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার বললেন, ‘সমাজ সংসার মেনে নেবে তো?’ আমি বললাম, ‘সমাজ আমি মানি না— বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। যত কঠিন ও দুঃসাধ্য হোক না কেন আমি আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। সব কিছু শেখার জন্যে— জানার জন্যে আমি যে-কোনও কঠিন কাজ করতে প্রস্তুত।’ উনি তখন আমাকে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে শুদ্ধ কাপড় পরে ওঁর সামনে বসার নির্দেশ দিলেন। ওঁর নির্দেশমতো হাত মুখ ধুয়ে এসে ওঁর সামনে বসলাম। ‘তোমার সমাজ যদি ত্যাগ করেও আমি তোমায় ত্যাগ করব না—তবে তোমায় কিছু পরীক্ষা দিতে হবে। একলব্যকে যেমন দ্রোণাচার্য পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন আমিও তোমায় পরীক্ষা করে নেব।’ আমি বললাম, ‘যদি আপনি নিতে পারেন তবে আমিও দেবার জন্যে প্রস্তুত থাকব সদাই।’ এর পর হাতে হাত রেখে দীক্ষামন্ত্র পড়ে দীক্ষা নিলাম।
এরপর থেকে যাওয়া আসা শুরু হল ওঁর দরবারে, সেখানে গিয়ে নানান প্রশ্ন রাখতাম আধ্যাত্মিক জগৎ নিয়ে এবং ‘এলাম মারফৎ’ তথ্য তত্ত্ব সম্পর্কে জানতাম। একদিন গিয়ে বললাম, ‘বাবা আমার খাতার গান মুখস্থ হয় না।’ উনি বললেন, ‘ওগো তোমাকে আর খুব একটা খাতা খুঁজতে হবে না। কারণ আমার এই দেহ-খাতার দিকে লক্ষ রাখো। প্রয়োজনে আমি আসরে গান পৌঁছে দিব।’ সেই থেকে তেমন আর খাতাপত্র পড়ি না, আসরে গান করতে উঠলেই গুরুদেবকে স্মরণ করি তখন প্রতিটি গানের প্রশ্নের উত্তর আপনিই মনের মধ্যে বা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মঞ্চে উঠে অথবা ওঠার আগে বর্তমান পরিস্থিতিকে নিয়ে কোনও গান গাওয়ার প্রয়োজন দর্শক তথা কর্তৃপক্ষ বললে ঠিক সেই মুহূর্তে গুরুদেবকে স্মরণ করলে আমি দেখেছি আপনিই সেই গান প্রসঙ্গে নানা ছন্দভাষা মনে উদয় হয়ে যায়।
একদিন এক বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে ঘর বর দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে যা খেয়েছিলাম বা ওরা যা খাইয়েছিল আমি যথেষ্ট বেছে বা দেখেশুনে খেলাম। বাড়ি এসে রাতে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত্রি দেড়টা নাগাদ স্বপ্ন দেখলাম একটি কড়াইয়ে কে যেন আগুনকে জ্বাল দিয়ে জলের মতো তরল করল। তারপর দুজনে ধরে যেন আমার গায়ে ঢেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট যন্ত্রণায় আমি যেন ছটফট করতে লাগলাম। ভয়ংকর চিৎকার করে উঠতেই দেখছি আমার স্ত্রী আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কি হল? তুমি অমন করছ কেন?’ আমি চেতন হয়ে মানে ঘুম ভেঙে দেখছি সারা শরীরে ধুলো লেগে, আর সারা শরীর লঙ্কাবাটা দিলে যেমন জ্বালা করে তেমনি জ্বলছে আর সারা শরীরে অসংখ্য ছুঁচ কে যেন ফুটিয়ে দিচ্ছে। জ্বলনে ছটফট করতে করতে কাঁদতে লাগলাম। আমার বাবা-মাও চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে আমার অবস্থা দেখে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন কী হয়েছে? আমি বললাম, ‘কি হয়েছে জানিনে কিন্তু সারা শরীর হু হু করে জ্বলছে আর কাঁটার মতো কি যেন বিঁধছে।’ ওঁরা খুব অবাক হলেন এবং দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। সারাটা রাত এই অসহ্য কষ্টের অনুভূতি নিয়ে কাটল। সকালে একজন কবিরাজের কাছে গেলাম। উনি হাত চালিয়ে বললেন ‘জ্বালাবাণের ওষুধ খাইয়ে তোমার সারা শরীর জ্বালিয়ে দিয়েছে।’ ওখান থেকে অন্য একজন ওস্তাদের কাছে গেলাম। ওই একই কথা বললেন, নানা ওষুধ খেলাম, অনেক ঝাড়ফুঁক করালাম, ডাক্তারি ওষুধও খেলাম, কিন্তু আমার শরীরের জ্বালা কেউ প্রশমিত করতে পারলেন না। তিনদিন তিনরাত্রি কষ্ট পাওয়ার পর কোথাও যখন জ্বালার উপশম হল না— তখন নিরুপায় হয়ে আনাখোলা জয়নাল বাবার দরবার শরীফে আমার দীক্ষা গুরুদেবের বাড়ি বিকাল চারটায় সময় গিয়ে পৌঁছুলাম। বাবা বারান্দায় বসে আছেন। গিয়ে প্রণাম করতেই উনি বললেন, ‘কি গো খুব কষ্ট হল আসতে। জ্বলন একটু হয়েছে, ভয় নেই গো, গুরু যার-সাহারা তার আবার ভয় কি? আমি তোমার সঙ্গেই আছি। চলার পথে একটু বিস্মরণ হলেই একটু জ্বলন সইতেই হয়। যাও তোমার মায়ের কাছে কিছু খেয়ে এসো তারপর বসবে।’ আমি মায়ের কাছে গিয়ে প্রণাম সেরে চা-মুড়ি খেয়ে এসে বাবার পায়ের নীচে বসলাম। কিন্তু আমার শরীরের জ্বালা এবং কাঁটাবেঁধার অনুভূতির কথা তখনও বাবাকে কিছু বলিনি বা বলার সুযোগ হয়নি। কয়েকজন শিষ্য চারপাশে বসে আছেন। আমি ভাবছি আমার শল্পীরের কষ্টের কথা বাবাকে কীভাবেই বা জানাব? সন্ধ্যা নেমে এল। বাবা বললেন, ‘কেউ সেজরা শরীফ পাঠ করো।’ একজন মুরিদ উঠে দাঁড়িয়ে সেজরা শরীফ পাঠ করলেন। কিছুক্ষণ পর বাবা বললেন, ‘যতীন দু’-একটি গান গেয়ে শোনাও।’ আমি বললাম, ‘বাবা শরীরের অবস্থা ভাল নয়।’ উনি বললেন, ‘সেই জন্যেই গান করতে বলছি গো। গাও, তুমি গাইবে আর আমি শুনব। ওগো গুরুদেবকে আর গুণকীর্তন শোনাতে যন্ত্র লাগে না।’ যন্ত্র ছাড়াই আমি পরপর পাঁচখানা গান গেয়ে শোনালাম। উনি নিশ্চুপ হয়ে আমার গান শুনে বললেন, ‘যতীন একটু তেল নিয়ে এসো, আমার পায়ে দিয়ে দাও। শরীরটা ভীষণ জ্বালা পোড়া করছে।’ আমি মনে মনে অবাক হয়ে ভাবছি বাবা তো কোনওদিন কাউকে পায়ে তেল ডলে দিতে বলেন এমন শুনিনি, অথচ আজ উনি ও-কথা বলছেন কেন? উঠে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে তেলের বাটি নিয়ে এসে নিজে হাতে ওঁর দু’পায়ে তেল মালিশ করে দিতে দিতে কখন যেন বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি, চমকে উঠে বাবা বললেন, ‘শরীরটা বড় ক্লান্ত, যাও মায়ের খাওয়ার ডাক পড়েছে।’ আমি আমার কথাটা বলার জন্য ইতস্তত করছি। উনি ‘যাও তোমার মা ডাকছেন, খেয়ে এসো’ বললেন। আমি কোনও কথা না বলে উঠে মায়ের দেওয়া ভাত খেয়ে এসে পায়ের কাছে বসে দেখছি কেউ নেই, বাবা একা। ভাবলাম এই সুযোগ। বললাম, ‘বাবা আমার দেহের অবস্থা খুব খারাপ। এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম— তারা আমায় “জ্বালাবাণের” ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। আজ তিন দিন তিন রাত্রি দু’চোখে ঘুম নেই। সারা শরীর জ্বলে গেল।’ উনি শুনে হেসে বললেন, ‘তোমাকে তারা ওষুধ খাইয়েছে, আর তুমি এসে তোমার গুরুর বাড়ি মায়ের হাতে ভাত খেয়েছ। যাও সমান সমান হয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে পড় গিয়ে। সকালে উঠে একগ্লাস জল-পড়া করে দেব, তুমি খেয়ে নেবে, সব ভাল হয়ে যাবে। যাও তোমার গুরু সাহারা কোনও ভয় নেই।’ আমি উঠে গিয়ে শুয়ে পড়লাম সেই ঘরের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম— ঘুম ভাঙল সকালবেলায় একজন পিরভায়ের ডাকে। উঠে দেখি বাবা কলের কাছে দাঁড়িয়ে, কাছে যেতেই বাবা এক গ্লাস জল ফুঁকে দিয়ে আমার হাতে দিলেন। আমি জলটা এক নিশ্বাসে চুমুক দিলাম। তারপর শরীরটা অদ্ভুত ঠান্ডা হয়ে এল, সেই তীব্র জ্বালা, কাঁটা-বেঁধা সবই উধাও। শরীর একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেল। বাবা বললেন, ‘আর কোনও অসুবিধে নেই তুমি সোজা বাড়ি চলে যাও। বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তা করছে।’ আমি সুস্থ দেহমন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।