এখন যেটা মূল সমস্যা সেটা হল আমাদের মতো ভদ্রলোকদের হালচাল এবং বাউল ফকিরদের সম্পর্কে প্রকৃত দৃষ্টিকোণ গড়ে তোলার অভাব। সত্যিই তাদের প্রতি আমাদের মমতা আর সহানুভূতি আছে। আমরা জানতে চাই তাদের জীবনধারা, বুঝতে চাই সমস্যা। হয়তো যেতে পারি না তাদের দরিদ্র যাপনের পল্লিপরিবেশে, কিন্তু তাদের আনতে চাই আমাদের বৃত্তে, শুনতে চাই তাদের সংলাপ। তাদের গান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও সমাদর করে শোনে ছাত্রছাত্রীরা— তার পেছনে কিছু অধ্যাপকের আনুকূল্যও থাকে। সরকারি প্রয়াসে নানা জেলার অজানা কিন্তু প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন বাউল ও ফকিরদের গান ক্যাসেটবদ্ধ করে নিতান্ত স্বল্পমূল্যে বিক্রি হচ্ছে, যার মূল্য লক্ষ্য প্রচার। গান ও গায়কের প্রচার।
এসব তো খুবই ভাল প্রয়াস, কিন্তু আমরাই মাঝে মাঝে বোকামি করে বসি। যেমন বছর কয়েক আগে বাউলদের নিয়ে একটা সেমিনারে যোগ দিতে গিয়েছিলাম বাংলা আকাদেমি চত্বরে। তার বাইরে স্টেজ বেঁধে গান হবে, দুপুরে আকাদেমির ঠান্ডা ঘরে সেমিনার— আমার অংশ সেখানেই। সময় বৈশাখ, রুদ্র বৈশাখ। অতবড় রবীন্দ্রসদন চত্বর রোদে পুড়ে যাচ্ছে। দুপুর দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত আলোচনা— ‘লোকজীবনের সমস্যা: আমাদের কর্তব্য।’ এ বিষয়ে বলব আমরা সুধীজন। সাড়ে বারোটা নাগাদ রোদ্রের ভ্রূকুটি সামলে পৌঁছলাম। কর্তৃপক্ষ দিলেন কোল্ড ড্রিংকস। লোকশিল্পীরা এসে গেছেন। সেদিন রবিবার, তাই আকাদেমির ছুটি। তার বাইরের ছায়াচ্ছন্ন অংশে ডেকরেটরের ব্যবস্থাপনায় বেঞ্চি আর হাইবেঞ্চি পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। টানা বেঞ্চিপাতা। জনা তিরিশ শিল্পীকে খেতে দেওয়া হয়েছে একসঙ্গে। ভাত-ডাল-ভাজা-মাছ-চাটনি। খুব তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছেন তাঁরা। অবশ্য গরমের একটা হলকা রয়েছে কিন্তু তাতে এই গ্রামীণ মানুষদের কী এসে যায়? আমাদেরও খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। বেলা একটা বাজে, চনমনে খিদে। বলে বসলাম, ‘আমরাও তো লাইনে বসে যেতে পারি পরের ব্যাচে।’ আমার আগ্রহ ছিল দু’কারণে। এক নম্বর নিশ্চয়ই খিদে, সেটা গৌণ। আসলে ভাবছিলাম এঁদের সবকিছুর ভাগীদার হওয়াই তো উচিত। আলোচনাচক্রের উঁচু মঞ্চে বসে, ব্যবধান টেনে, শুধু বক্তৃতা আর জ্ঞানদান কি শোভন? এঁদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলে ওঁরাও তো উৎসাহ পাবেন, ভরসা পাবেন। জীবনের সর্বস্তরেই বিভাজন দেখে ওঁদের নিশ্চয়ই বেশ বিভ্রান্ত লাগে। আমাদের আপ্যায়নেও ফাঁক ধরা পড়ে যায়।
আমার প্রস্তাবে অবশ্য জল ঢেলে দিলেন একজন কর্তাব্যক্তি। হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, ‘উঁহু, তা কী করে হবে? আপনারা হলেন স্পিকার। আপনাদের আলাদা ব্যবস্থা। এই এঁদের নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ দিয়ে দাও।’ অচিরে আমাদের একটা ঘরে এনে চেয়ার টেবিলের সামনে বসিয়ে, ক্যাটারারের লোগোচিহ্নিত সাদা বাক্স করে লাঞ্চ প্যাকেট দেওয়া হল। ক্ষুন্ন মনে সেটা উন্মোচন করে পাওয়া গেল একদলা শুকনো ফ্রায়েড রাইস, একটুকরো মুরগির ঝোলবর্জিত নির্মমতা, সকালে-কাটা গাজর-বিট-শসার স্যালাড, প্লাস্টিক মোড়া এক পিস করুণ থ্যাঁতলানো সন্দেশ এবং এসব খাদ্য মুখে তোলার জন্যে এক চিলতে প্লাস্টিক চামচ। কত কষ্টে সেসব গলাধঃকরণ করতে লাগলাম ঘন ঘন জল সংযোগে। সেই মুহূর্তে অন্তত লোকশিল্পীদের খুব ভাগ্যবান মনে হল। ভদ্রলোক ও ইনটেলেকচুয়াল হবার কী বিড়ম্বনা! আলোচনাচক্রে অংশ নেবেন এমন একজন বক্তা আমাকে নিচু স্বরে বললেন, ‘মুরগির পিসটা শুধু দন্তস্ফুট করার অযোগ্য নয়, রীতিমতো দুর্বিনীত। ওর বোধহয় আত্মদানে ততটা উৎসাহ ছিল না। বয়সেও আমাদের কিঞ্চিৎ অগ্রজ, কী বলেন?’
আমি মৃদুহেসে সমর্থন করে বললাম, ‘আহা, আমরাও তো বাইরের ওই ভোজটা খেতে পারতাম। ইস, ওরা কী ভাগ্যবান, পেটপুরে খেলো।’
বক্তা বললেন, ‘উঁহু, ওটা হল লোকখাদ্য। আমাদের কি ওসব খাওয়া শোভা পায়? আমরা হলাম গিয়ে রিসোর্স পার্সন। আমাদের জন্যে তাই স্পেশাল লাঞ্চ প্যাকেট… স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট।’
এর পরের অংশটুকু অবশ্য আরও করুণ। দুটো নয়, আড়াইটে নাগাদ শুরু হল ঠান্ডা ঘরে মহতী আলোচনা চক্র— ‘লোকজীবনের সমস্যা: আমাদের কর্তব্য।’ ভবিযুক্ত হয়ে আমরা মঞ্চে বসলাম। সঞ্চালক শুরু করলেন তাঁর ভাষণ। সেই বৈশাখের খাঁ খাঁ দুপুরে কোন কলকাতাবাসী আর আসবেন শ্রোতা হয়ে? কাজেই চেয়ার ভরা পঞ্চাশজন লোকশিল্পী, দশজন উদ্যোক্তা, পাঁচজন বেকার আর চারজন বক্তা শুরু করলেন আমাদের কর্তব্য বিষয়ে কূট-কচালি বিচার বিবেচনা। প্রথম বক্তা এতটাই তাত্ত্বিক আর পুথিপড়া পণ্ডিত যে লোকজীবনের সংজ্ঞা নিয়ে বিশদে বোঝাতে লাগলেন। লোকশিল্পীরা তাঁদের কর্তব্য সম্পর্কে একটুও দ্বিধা না রেখে নিপাট নিদ্রাতুর হয়ে পড়লেন। একদিকে লোকখাদ্য আরেকদিকে ঠান্ডা ঘর— এই দ্বান্দ্বিক বিন্যাসে আমার সেটাই সবচেয়ে ছন্দোময় মনে হল।
এবারে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে হবেই যে, বুদ্ধিজীবী নগরবাসীদের এহেন অবিবেচনার কারণ কী? আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানের কোনও গুরুতর অভাব বাস্তবজীবনে খুব একটা দেখাই না, অথচ প্রশ্নটা যখন লোক-লোকায়তের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তখন কেন আমরা বেহিসেবি কাজ করে বসি? পল্লিজীবনের সঙ্গে আমরা যে নিতান্ত অপরিচিত তাও নয়। এই অবিবেচনার সংকট যে কেবল কলকাতার মতো মেট্রোপলিটন শহরেই দেখা যায় তা নয়। নগরতলিতেও এমন ঘটে, ঘটতে পারে। একটা নমুনা দেব।