মনের ঝোঁক জেদ আরও বেড়ে গেল। দিনরাত শুধু গানই আমার ধ্যান, গানই আমার সাধনা। ন’মাস পরে ওই শিল্পীকে আমাদের গ্রামের এক আসরে পেলাম। এর সঙ্গে সারারাত্রি পাল্লা গান করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন রেখে বুঝিয়ে দিলাম অন্যায় বিচার করে বড় হওয়া যায় না।
এদিকে বাবা-মা আমার কথা অনুযায়ী একটি ১২/১৩ বছরের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ আনলেন। মেয়েটি দেখতে সুশ্রী, আমাদের পরিবারের সব কথাই খুলে বলেছেন বাবা। বিয়ের দিন ধার্য হল। দু’দিন পরে দু’জন মানুষ আমাদের বাড়ি এলেন আমাকে দেখতে সন্ধ্যার সময় নানান কথা চলছে, দেনাপাওনা কিছুই নেই, শুধু একটি লালপাড় শাড়ি পরিয়ে বিয়ে হবে ঠিক হল। ৩০/৩৫ জন বরযাত্রী যাবে—এ কথাও হল। সবশেষে মেয়ের দাদা আমার একতারা হাতে নিয়ে পরপর দু’খানা বাউল গান গেয়ে শোনালেন এবং জানালেন উনি গান করেন। শুনে মনে খুব আনন্দ ও উৎসাহ জাগল। ভাবলাম মেয়ের দাদা যখন বাউল গান গাইল— নিশ্চয়ই কোনও বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না এরা। এর পর আটদিন পর চুলদাড়ি কেটে ধুতি পাঞ্জাবি পরে টোপর মাথায় দিয়ে বিয়ে করে আনলাম। নতুন বউ ঘরে এনে ফুলশয্যার রাতে বললাম, ‘আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী— সামনে আমাদের যে দিনগুলি— শুধু খাওয়া শোওয়া নিয়ে আমরা জীবন কাটাব না, আমি বাউল রসের কর্ম তোমাকে নিয়ে করতে চাই। সে কর্ম যতই জঘন্য হোক তোমার মুখ থেকে “না” শুনতে চাই না। এতে তোমার অভিমত কী?’ আমার স্ত্রী বলেছিল, ‘আমি এতকাল বাবামায়ের ছিলাম, ওরা আমাকে চিরদিন রাখতে পারল না, তাই তোমার হাতে তুলে দিয়েছে। আমি তোমার। তুমি যে কর্ম বলবে বা করবে আমার মুখ থেকে “না” শব্দ কোনওদিন উচ্চারণ হবে না, সে যতই কঠিন হোক।’ স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল উৎসাহ পেয়েছিলাম। তাই গোঁসাই-এর শিক্ষা দেওয়া কর্ম নিজে স্বামী স্ত্রীতে হাতে-কলমে শুরু করলাম। ত্রুটি মনে হলেই গোঁসাইকে গিয়ে প্রশ্ন করতাম বা সঠিক যোগের হিসাব নির্ণয় করে নিতাম। এইভাবে কেটে যেতে লাগল— দ্বিতীয় মিলন জীবনের বৈষ্ণব কর্মজীবন। মনে মনে চিন্তা করলাম হাউড়ে গোঁসাই-এর একখানি গানে বলেছে সংসার করব কিন্তু সৃষ্টির পথ অবরুদ্ধ রাখব (‘হাউড়ে বলে রাখব না আর বংশে দিতে বাতি’)। এই চিন্তা ধারা নিয়ে জীবনের পাঁচটি বছর অতিক্রান্ত হল।
এবার এক নতুন সমস্যা দেখা দিল। দীর্ঘদিন গান গেয়ে বাইরে কাটানোর পর বাড়ি ফিরে এলে স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করল। আমি গ্রাম গ্রামান্তরে গান গেয়ে ফিরি। কিন্তু স্ত্রী ঘরে একা বড় শূন্যতার মধ্যে থাকে। একদিন বলেই ফেলল ‘তুমি বিভিন্ন গ্রামে গান করে বেড়াবা আর আমি একা ঘরে চুপ করে শুয়ে পড়ে থাকব— এটা হয় না। যদি একটি ছেলেমেয়ে না হয়— তা হলে একা থাকব কী করে? সন্তানহীন বাড়ি বড় বেমানান।’ বাবা-মাও একই কথা বারবার বলতে লাগলেন। সংসারের এই হাল দেখে এবং সকলের কথা শুনে গোঁসাই-এর যোগের হিসাব করে একটি শুভ যোগ দেখে বীজবপন করলাম এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুভক্ষণে জন্ম নিল একটি মেয়ে। বাড়িতে সকলের ইচ্ছা একটি পুত্র সন্তান হোক, আমিও ছেলেই হবে বলেছিলাম মুখে, কিন্তু গোঁসাইয়ের ছক অনুযায়ী মেয়ের যোগে বীজ বপন করলাম—অথচ মুখে স্ত্রীকে একথা না জানিয়ে ছেলেই হবে জানালাম। এই দ্বিচারিতার কারণ হল—বংশবৃদ্ধি চাইনি আমি—অথচ সংসার ও স্ত্রী সন্তান চায়— তাই মুখে পুত্র হবে বললেও কার্যত একটি কন্যা-সন্তানেরই জন্ম দিলাম। ভেবে দেখলাম— মেয়েটি বড় হলে বিবাহ দিলে গোত্রান্তরিত হবে—আমার বংশবৃদ্ধি হবে না। তা ছাড়া পুত্র জন্মালে বংশবৃদ্ধি যেমন হবে তেমন সে যে আমার কর্ম করবে এমন কোনও কথা নেই।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন ডাঃ একরামূল হক মানে আমার ওস্তাদ, আমার বাড়ি এলেন এবং জানালেন আগামী ১৪ই চৈত্র বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার আনখোলা গ্রামে আমাকে গান গাইতে যেতে হবে পির সাহেবের বাড়ি। আমি এর আগে বৈরাগ্যতলা, অগ্রদ্বীপ ধাম, পাথরচাপুড়ি, কল্যাণী ঘোষপাড়া সতীমায়ের মেলা— প্রভৃতি বিভিন্ন মেলায় গান করেছি— যে সব সাধু-বৈষ্ণব দর্শন করেছি তাঁদের প্রত্যেককে একটি প্রশ্ন করেছি। কিন্তু কেউই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। প্রশ্নটি হল— ‘আয়না লাগে নিজের মুখ দেখতে গেলে—আয়না ছাড়া নিজের মুখ দেখার উপায় কি?’ আরেকটি প্রশ্নও করি— ‘সেটি হল বাড়িতে বসে রেডিওর সুইচ টিপলে নির্দিষ্ট নম্বরে আকাশবাণী কলকাতার কথা বা গান, খবর শোনা যায় বিনা তারে। আমি থাকব বাড়িতে আর গুরুদেব থাকবেন তার নিজের বাড়িতে, বিনা তারে তাঁর সঙ্গে কথোপকথন হবে কি ভাবে? আপনারা কেউ কি পারবেন আমাকে এই তথ্য বা তত্ত্ব বুঝিয়ে দিতে বা কথোপকথন করতে?’ কোনও গুরুবৈষ্ণব বলতে পারেননি যে তিনি পারবেন। তাই আমার দীক্ষা মন্ত্রও সে পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। তাই বর্ধমান জেলায় যখন গান করতে গেলাম ডাঃ একরামূলের সঙ্গে, তখন পিরবাবার বাড়িতে উর্স্ উপলক্ষে বিভিন্ন গান পরিবেশন করে শোনালাম। গান শেষে সকাল বেলায় পিরবাবার সামনে গিয়ে বসলাম বিদায় নেবার জন্যে। অপূর্ব জ্যোতির্ময় পুরুষ। দর্শনেই প্রত্যয় হয় তাঁর সাধক সত্তা। সুডৌল দোহারা লম্বাদর্শনধারী মানুষ। মনে পড়ে গেল আমার গোঁসাই বাবার কথা, গোঁসাই বলতেন, ‘গুরু গুরু সর্বলোকে কয় আর গুরু দর্শন হওয়ামাত্রই কৃষ্ণপ্রাপ্তি হয়।’ যে গুরুর মুখচন্দ্রিমার মধ্যে কৃষ্ণের জ্যোতির্ময় আভা উজ্জ্বল প্রতিভা ভেসে ওঠে, সেই গুরু স্বয়ং গোবিন্দ। তাই পিরবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এদিক ওদিক চাইতে থাকলাম। পিরবাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি গো আমার এখানে কোন অসুবিধা হল না তো?’ আমি বললাম ‘না’। উনি বললেন, ‘গান কোথায় শিখেছ?’ আমি বললাম ‘বাল্যগুরু জাফরউদ্দিনের কাছে, আমার বাড়ির কাছেই একই গ্রামের মানুষ। আর এখন গুরু হলেন ডাঃ একরামূল হক।’ একরামূল হক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন নত মস্তকে। তারপর পিরবাবা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু টাকা দিতে এলেন। আমি বললাম, ‘টাকা পয়সা আমি আপনার কাছ থেকে কিছু নেব না।’ উনি স্মিত হেসে বললেন, ‘কি নেবে?’ আমি বললাম, ‘আয়না লাগে নিজের চেহারা দেখতে হলে। আয়না ছাড়া নিজের চেহারা দেখা যায় কি ভাবে? তা ছাড়া আপনি থাকবেন আনখোলায় আর আমি থাকব কাপাসডাঙ্গায়, বিনা তারে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হবে কি ভাবে? এই কর্ম বা পদ্ধতি আপনাকে দিতে হবে।’ আমার কথা শুনে উনি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ দেবো আমি। ঐ জন্যেই বসে আছি। আর ঐ কর্তব্য ঠিকঠাক পালনের জন্যেই এনায়েতপুর গ্রাম, মেদিনীপুর জেলার খোদা নেওয়াজ সামসুল আউলিয়ার দরবার থেকে মাথায় পাগড়ি নিয়ে বসে আছি। এই তথ্য তত্ত্ব জানানোই আমার কাজ। তবে এসব জানতে হলে তোমাকে আমার কাছে বায়েত করতে হবে। আর আমার কাছে দীক্ষামন্ত্র নিলে তোমার জাত যাবে, তোমার সমাজ তোমাকে ত্যাগ করবে। বাবা-মা এঁরা কেউই তোমাকে মেনে নেবেন না। তাই আমার ইচ্ছা এই যে বাড়ি গিয়ে বাবা-মা-কে জিজ্ঞাসা করে অনুমতি নিয়ে আসলে তবেই তোমায় আমি দীক্ষা মন্ত্র দেব।’