খিদের সময় কোনও হোটেলে খেতাম, কোনও টিউবওয়েলে স্নান করতাম আর স্টেশনে পড়ে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বিভিন্ন স্টেশনে নেমে কোনও মন্দির বা কোনও পির মাজার অথবা পুরনো রাজবাড়ির নাম শুনলেই দেখে আসতাম। তারকেশ্বর মন্দির, হাওড়া পুলের নীচে হিন্দুস্থানিদের মন্দির, ফুল মার্কেটের পাশে গঙ্গার ধার—এ ছাড়াও নবদ্বীপধাম অথবা নামী মন্দির যেখানে শুনেছি সেগুলোও দর্শন করে আসতাম। এই ভাবে সাত মাস ট্রেনে ঘুরে ঘুরে একদিন ব্যান্ডেল স্টেশনে শুয়ে সকালে হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছি। দেখছি সারা হাত মশায় খেয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। দেখে মনটা দমে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পানের দোকানে আয়নায় দেখছি মুখের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে মুখে হাম বেরিয়েছে। মুখের ও দেহের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। গাড়িতে ক্রমাগত গান করে করে বুকে গলায় ব্যথা, নিজের কণ্ঠস্বর অপরিচিত লাগে। এভাবে ঘুরে বেড়ালে আমাকে অকালে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে, রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুর বেড়ালের মতো মরে থাকতে হবে। না এটা আমার করা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে বাড়ি যেতেই হবে।
বাড়ির পথে রওনা হবার জন্যে তৈরি হলাম নিজে। মুখ ধুয়ে দোকানে চা খেয়ে—একমুখ চুল দাড়ি, পায়ে টায়ারের চটি, গায়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবি, পরনে মার্কিন থান—জরাজীর্ণ শরীরে বাড়ি ঢুকলাম। সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়ল আমায় দেখতে। বাবা মা সবাই আমার চেহারার অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগল—ছোট ভাই বোনেরাও কাঁদছে। এই সাত মাস কত যে কষ্ট, কত না হোটেলে খেয়ে বেড়ালাম। স্নান সেরে মায়ের দেওয়া ভাত খেতে বসে পিছনের কথাগুলি মনে পড়ছিল। কারণ গত সাত মাসের মধ্যে একদিন বোলপুর স্টেশনে বিশ্রাম ঘরে মেঝেতে খালি গায়ে শুয়ে আছি, ডুগি একতারা বুকের পাশে হাতে চাপ দিয়ে রেখেছি। মশার কামড়ে ঘুম আসছে না, রাত্রি তখন প্রায় পৌনে বারোটা। এমন সময়ে দেখছি একজন খাটো চেহারার লোক, মাথায় উসকো খুসকো চুল, পরনে বিশ্রী ছেঁড়া লুঙ্গি, গায়ে একটা ছেঁড়া কালো হাওয়াই শার্ট—আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে টানছে আর বলছে,—‘আরে এখানে শুয়ে আছিস, আমি তোকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওঠ এতক্ষণ বোধ হয় সকলের খাওয়া হয়ে গেল। চল ওঠ দেরি করলে হবে না।’ আমি অবাক হয়ে ওই লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমায় কোথায় যেতে হবে, আর তুমিই বা কে? তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না!’ ওই লোকটি বলল, ‘আরে চিনাজানা পরে হবে তুই তাড়াতাড়ি ওঠ।’ আমি উঠে বসে বলছি, ‘আরে হাত ছাড়ো কি ব্যাপারটা বল।’ ও বলল, ‘এই খ্যাপা তুই বুঝতে পারছিস না, আরে ও পাড়ার বাজারে বাবুদের বাড়ি, মানে ওরা বিরাট বড়লোক, ওদের বাড়িতে আজ বিয়ে। বহু লোকজন খাওয়ান দাওয়ান হচ্ছে। একটু আগে গিয়ে বসতে পারলেই পেট পুরে দুটো খাওয়া যাবে।’ আমি ওর কথাটা শুনে বললাম, ‘বিনা নিমন্ত্রণে গুরুর বাড়ি খাওয়াও নিষেধ বলে জানি। আমি বিনা নিয়ন্ত্রণে ভদ্রলোকের বাড়ি খেতে যাব কী করে? বলা নেই কওয়া নেই আর ওদের বাড়ি গিয়ে খেতে বসব? তুমি যাও আমি ঘণ্টা দেড়েক আগে হোটেল থেকে খেয়ে এসেছি, আমি যাব না।’ আমার কথা শুনে— হাত ছেড়ে দিয়ে রেগে বলল, ‘তুই বড়লোকের ব্যাটা তো, তোর মেলা টাকা, তাই তুই হোটেলে খেতে গেছিস। ওঃ ওঁকে নেমন্তন্ন করতে হবে। আবে আমাদের নেমন্তন্ন দুনিয়া জুড়ে, তুই থাক, তোকে খেতে হবে না, আমি একাই যাই।’ ওই লোকটি চলে গেল।
রাতে খাওয়া সেরে বাবাকে বললাম, ‘আমার বিয়ের দরকার হয়ে পড়েছে, তুমি মেয়ে দেখ। আমি বিয়ে করব; তবে শর্ত এই, যে-মেয়েকে দেখবে তাকে বা তার বাবা-মাকে বলবে, আমার ছেলে বাউল গান করে। যদি তারা মেনে নেয় বা আমার শিল্পী জীবনের পথে বাধা না দেয় তা হলে আমি তাকে গ্রহণ করব। যদি পরে চলার পথে বাধাসৃষ্টি করে তা হলে তাকে ত্যাগ করে চলে যাব।’ বাবা আমার কথা শুনে পরদিন খুব সকালে মাকে সঙ্গে নিয়ে আমার জন্যে মেয়ে দেখতে বেরিয়ে গেলেন। আমি একটু রাত হলে ওস্তাদ দাদুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমার গলার স্বর শুনে উনি উঠে বসে দাদিকে দরোজা খুলতে বললেন। আমাকে দেখেই উনি বলে উঠলেন, ‘কতদূর গিয়েছিলি?’ আমি সেখানে যা করেছি সমস্ত কথা খুলে বিস্তারিত বললাম। উনি শুনে হেসে বললেন, ‘তোকে যা শিক্ষা দিয়েছিলাম তা অত দূর পর্যন্তই প্রচার হল। ওরে মানুষ হতে গেলে বা মানুষের সন্ধান পেতে হলে, এই মানুষের মধ্যেই অনুসন্ধান করতে হয়। পালঙ্ক বা ঐশ্বর্য সুখের মধ্যে পরম পুরুষকে পাওয়া যায় না। জীবনটাকে কষ্টের মধ্যে ডুবিয়ে ধুয়ে নিলেই সোনালি রং ফুটে উঠবে। বিশ্বের মাঝে প্রতিষ্ঠা হতে হলে চাই অক্লান্ত পরিশ্রম। যতই ঘুরবি ততই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে। আর চলমান জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতাই একদিন তোর কাজে লাগবে।’ এরপর দাদুকে বললাম, ‘দাদু আমার নূরতত্ত্ব গান নেই, গান কোথায় পাবো? উনি বললেন, ‘নূরতত্ত্ব গান আমার অনেক লেখা ছিল, কিন্তু সে গান এখন আমার একটিও নেই। তবে তোর শিক্ষার জন্য, আমি কাল একজন জ্ঞানী উস্তাদকে আসতে খবর দিব। আমার পরিচিত এবং বড় শিক্ষিত মানুষ। শব্দফকিরি গানের জাহাজ বলা যায়। তুই তার কাছে যে-কোনও গান নিতে বা শিখতে চাইলেই পাবি। তিনি দয়া করে যদি দেন তা হলে, কেউ তোর হাতে আর হাত দিতে পারবে না।’ তারপর দিন সন্ধ্যায় দাদু আমাকে ডেকে পাঠাল। আমি গিয়ে দেখি ওরা তিনজনে বসে, মানে আমার উস্তাদ দাদু, আরও পাড়ার একজন, ছাড়া অল্পবয়স্ক পাতলা স্বাভাবিক চেহারার অতি ভদ্র নম্র ভাবের একজন শান্ত মানুষ, পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে একজোড়া দামি চটি। দেখে মনে হয়েছিল ও-পাড়ায় হয় তো বিয়ে হয়েছে, অষ্টমঙ্গলা চলছে, তাই এ-পাড়াতে হয়তো বেড়াতে এসেছে। আমি সামনে দাঁড়াতেই ওস্তাদ বললেন, ‘আয় বোস্। এই লোকের জন্যেই তোকে বলেছিলাম, এঁর নাম ডাঃ একরামূল হক, বাড়ি রামেশ্বরপুর গ্রামে, পাশে বোস্, কি বলে শোন্।’ উনি মানে ডাঃ একরামূল হক আমাকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ আমি বললাম ‘যতীন হাজরা’, ‘লেখাপড়া কতদূর জান? মানে পড়াশোনা কতদূর করেছ?’ আমি বললাম, ‘৮/৯ ক্লাস পড়েছি।’ তারপর বললেন, ‘তোমার সম্পর্কে সব কিছুই শুনলাম। এখন তোমার কণ্ঠে একখানা গান আমি শুনব।’ আমি বললাম, ‘একটু পরেই ও-পাড়াতে গান গাইতে যাব, ওখানে গেলেই ভাল হয়।’ উনি বললেন, ‘চল আমি তোমার গান শুনে তারপর বাড়ি যাব।’ এরপর ও পাড়ায় গান গাইতে গেলাম, ওখানে গ্রামের আরও দু’-চারজন ফকিরি গান করল। শুধু শিক্ষার জন্য চললাম গান করতে। গানের আসর চলছে, আমার সঙ্গে ও-পাড়ার ফকিরদের পাল্লাগানের ফাঁকে উনি উঠে বা আরও অনেকে অনুরোধ করায় উনি হাউড়ে গোঁসাই-এর চারখানা গান পরিবেশন করলেন। উনি ইতিপূর্বে এখানে শিল্পী হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। গানের সুর ও গায়নভঙ্গির নতুনত্বে সকলের তারিফ পেলেন। গানের শেষে উনি বললেন, ‘তুমি আগামী বুধবার আমার বাড়ি যাবে।’ আমি নির্দিষ্ট দিনে ওঁর বাড়ি গেলে ওঁর বিভিন্ন আলোচনা ভাব ভাষা বা প্রতিটি গানের ছন্দ অপূর্ব লাগল। এদিন থেকে প্রত্যেক বুধবার সকালে স্নান সেরে ওঁর বাড়ি যাওয়া আসা করতে লাগলাম। ওঁর খাতায় বিভিন্ন মহাজনের লেখা গান, অথবা নিজের রচনা গান খাতায় সারাদিন বসে বসে লিখতাম। প্রতিটি গানের কলির অর্থ ওঁকে প্রশ্ন করে জেনে নিতাম। ওঁর অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার আমায় বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করত। ওঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা আমায় এতদূর বিস্মিত করেছিল যে আমি অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য, ওঁর সান্নিধ্যে না এলে বা গুরু হিসেবে ওঁকে না পেলে আমার শিল্পীজীবনে কোনও পূর্ণতাই আসত না। বহু সুকঠিন বিষয় ওঁর অসামান্য বিশ্লেষণী শক্তিতে আমার মনের দরজা সহজেই উন্মোচিত হত। এক নতুন জগৎ আমার চোখের সামনে খুলে গেল। ওঁর সহজ করে বোঝানোর গুণে সব কিছু বুঝতে লাগলাম। একদিন একটি গ্রামে গান করতে গেলে ‘নবুওত’ ‘বিলাওত’ প্রসঙ্গে পাল্লা দিল। আমি কোনও রকমে জবাবদিহি করে, গান গেয়ে ওঁর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। কারণ আসরে পাল্লা চলাকালীন বিচারকমণ্ডলী আমার বা পাল্লাদার শিল্পীর গান বিচার করে আমার হার রায় দিল, এতে মনে অসম্ভব ধাক্কা লাগল, ঠিক করলাম আর গান করব না। ডুগি একতারা ভেঙে ফেলে দেব ঠিক করলাম, বাড়ি না এসে ডাঃ একরামুল হকের বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। ওঁর কাছে গিয়ে সব ঘটনা অকপটে জানিয়ে গান আর কখনও না-করার সিদ্ধান্তও তাঁকে জানালাম। আমার মতে— এত ভাল করে গান করা সত্ত্বেও ইচ্ছা করে অপমান করার জন্যে— এই রায় দিয়েছে। উনি সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘ওরা ঠিকই করেছে। সম্মুখ সমরে এবার এর উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য নিজেকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রস্তুত কর। আজ থেকে তোমাকে আরও গভীরভাবে এই তত্ত্ব, এই গান শিখতে হবে। মনের মধ্যে যে রাগ জমেছে ভাল করে শিক্ষা নিয়ে ওই শিল্পীকে কোনও একটি আসরে ফেলে দাঁত ভাঙা জবাব দিতে হবে।’