তাই প্রত্যহ জানার কৌতূহলে সন্ধ্যায় যাওয়া শুরু করলাম। দেখতাম ওখানে যে সমস্ত ছেলে বা মানুষ যেত সকলেই প্রায় গাঁজা খেত। আর আমি গিয়ে ওদের পাশে বসে নানা গল্প করতাম। কিন্তু নিজে নেশা ভাং করতাম না বলে দূরে গিয়ে বসে থাকতাম। তাই নিজেকে শুধু পরপর বা একা লাগত। ভাবলাম এদের সঙ্গে কেমন করে কী ভাবে মেশা যায়। বাড়ি গিয়ে ওস্তাদ জাফরউদ্দিন মানে আমার প্রথম গানের গুরুদেবকে বললাম, ‘দাদু ওখানে যাচ্ছি বটে ওরা কেউ কোনও পাত্তা দিচ্ছে না। এভাবে ঘুরলে আমার জানতে বহুদিন সময় লেগে যাবে।’
উনি বললেন, ‘শিক্ষার প্রয়োজনে ঘর ঘাঁটিতে লাঠি হাতে ঘাট পাহারা দিতে হয়। জানার তাগিদে মুচির ঢাক বয়ে দিতে হয়। যেখানে গিয়েছিস ওই সমাজে মিশতে না পারলে কোনও কাজ উদ্ধার হবে না। প্রয়োজন হলে তোকেও ওদের সঙ্গে গাঁজা খেতে হবে।’ দাদুর নির্দেশ পেয়ে পরদিন গেলাম গোঁসাই-এর আখড়াতে। গোঁসাই বাবার পাশে বসে দু’-একটা কথা শুনতে বা বলতে বলতে বললাম, ‘বাবা আমাকেও না হয় কলকেটি দেন, খেয়ে দেখি কেমন লাগে।’ সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘অভ্যাস যখন নেই তখন অসুবিধা হবে।’ আমি বলেছিলাম, ‘দু’-এক টান করে খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে যাবে আপনিই।’ যাই হোক গোঁসাই-এর হাত থেকে প্রথম কলকে নিয়ে দু’টান দিতেই মনে হয়েছিল যেন বুকের মধ্যে আগুন প্রবেশ করে ফুসফুসটা পুড়ে গেল। এর পরেও কয়েক টান দিয়ে, সন্ধ্যার পরে হেঁটে, পাশের গাঁয়েই তো বাড়ি—রাস্তায় হোঁচট খেয়ে দু’-তিনবার পড়ে গিয়েছিলাম। মাথাটা ঘুরছিল, গা পাক দিয়ে বমি শুরু হয়েছিল। বাড়ি গিয়ে ভয়ে বাবা মাকে কিছু বলতে পারিনি। বিছানায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদেছিলাম। বারবারই মনে হচ্ছিল শিক্ষার জন্যে আমি কী করতে চলেছি। গাঁজা খারাপ জিনিস জেনেও আমাকে তাই খেতে হল। হোক। যেভাবেই হোক আর যত কষ্টই হোক আমি বাউল তত্ত্ব শিখব জানব। এইভাবে প্রত্যেকদিন যেতে লাগলাম। গিয়ে আমিও এক একদিন এক পুরিয়া গাঁজার দাম দিয়ে দিতাম। এইভাবে আমি ওদের সঙ্গে রোজ গাঁজা খেতে লাগলাম। যখন কেউ থাকত না তখন কোনও বাউল গান গেয়ে বাবাকে শুনিয়ে, সেই গানের অর্থ ব্যাকরণ করে বুঝে নিতাম। আস্তে আস্তে বাবার কাছে আমি বেশ প্রিয় হয়ে উঠলাম। আশ্রমে বসে মাঝে মাঝে ডুগি একতারা নিয়ে গিয়ে গোঁসাইকে গান শোনাতাম। বাবা কোনও ভক্তের বাড়ি গেলে আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। একদিন গঙ্গা পার হয়ে ওঁর মেয়ের বাড়ি যাব বলে দু’জনে বেরিয়েছি, গঙ্গার ঘাটে নৌকোয় চাপতে গিয়ে গোঁসাই বললেন,—‘তোর গলায় কোনও মালা নেই?’ আমি বললাম, ‘মালা মানেই তো সাইনবোর্ড ঝোলানো। দোকানে মাল নেই, আর শুধু শুধু সাইনবোর্ড টাঙিয়ে লাভ কি?’ উনি বললেন, ‘আমার ঝোলাতে এই মালাটি আছে তুই গলায় পর।’ আমি বলেছিলাম, ‘একদিনকার জন্য গলায় দেব না, যদি চিরদিনকার মতো আমাকে আমার বলে স্বীকৃতি দেন এবং নিজের হাতে মালাটি গলায় পরিয়ে দেন তা হলে আমি ওই মালা গলায় পরব।’ উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘বেশ তা-ই হবে, আজ থেকে তুই আমার ছেলে। আয়, আমি নিজের হাতে তোর গলায় মালা পরিয়ে দিই’ এই বলে নিজের হাতে সেই তুলসী কাঠের মালা আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। গোঁসাই বাবার কাছে প্রত্যহই আসা যাওয়া করতাম। উনি বলতেন, ‘বৈষ্ণব প্রকৃতি, রাধারানী হচ্ছেন প্রকৃত বৈষ্ণব। তোর ঘরে যে রাধা আছে ওর সেবা না করলে সুধা পাবি কোথা থেকে? ওকে ভক্তি দিবি একটু হাত বুলিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে।’ গোঁসাই বাবার এই বাণী মনে মনে মেনে নিয়ে আমি ভাবলাম বাউল গান বা তত্ত্ব শিখতে হলে বিয়ে আমাকে অবশ্যই করতে হবে। বাড়িতে গিয়ে রাত্রে বাবা বললেন, ‘বেশ তো অনেকদিন কেটে গেল। আমি একটি মেয়ের সন্ধান পেয়েছি, যদি তুমি রাজি হও তা হলে আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব বা আজই মেয়ে দেখতে যাব।’ শুনে যদিও মন চাইছে তবু পুরনো স্মৃতি আবার মনকে তাড়াতে লাগল, মনে হল বিয়ে তো মানুষের একবার। বারবার বিয়ে মানেই ব্যাবসা। আমি কি ব্যাবসা জুড়লাম নাকি? মনের মধ্যে বাবার ওই কথা শুনে রাগ হল। কাউকে কোনও কথা না বলে সকাল বেলায় ডুগি একতারা গাঁজা সিদ্ধের ঝোলা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় বেরিয়ে মনে হচ্ছে কোথায় যাই। সঙ্গে মাত্র বারো টাকা! বেলডাঙা স্টেশনে টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে দেবগ্রাম স্টেশনে নেমে একজন পরিচিত শিল্পী নইমুদ্দিনের বাড়ি হাটগাছা গ্রামে গিয়ে উঠলাম। আমাকে দেখে ওরা স্বামী-স্ত্রীতে বলল, ‘হঠাৎ এভাবে আসার কারণ কি?’ আমি বললাম ‘মানসিকভাবে আমি সুস্থ নই, মনের অবস্থা ভাল না থাকায় আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।’ ওরা আমাকে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগল। ওদের কোনও কথা না বলে আমি রাত্রিটা কোনওরকমে থেকে সকালে খুব ভোরে উঠে কাটোয়া ঘাট পার হয়ে কাটোয়া স্টেশনে ছোটলাইন প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসে দেখছি আমার পকেটে ২ টাকা ১০ পয়সা সম্বল। বেলা গড়িয়ে গেছে, পেটে ভীষণ খিদে লেগেছে। চায়ের দোকানে একটি পাউরুটি-চা খেয়ে পকেট শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যায় আর খিদে সহ্য হয় না। ভাবছি জীবনে কখনও কোনওদিন কারও কাছে হাত পাতিনি। ভিখারির মতো কেমন করে খাবার চেয়ে খাব। কিন্তু পেটের মধ্যে এমন যন্ত্রণা করছে যে আর সহ্য হচ্ছে না। বসে বসে খিদের জ্বালায় কাঁদতে লাগলাম। সারাদিনের মধ্যে মাত্র একটি পাউরুটি আর এক কাপ চা পেটে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে কাউকে কোনও কথা বলতেও লজ্জা করছে। হঠাৎ দেখি ছোট লাইনে ট্রেন এসে লাগল। সবাই গাড়িতে উঠছে, আমিও উঠলাম গিয়ে গাড়িতে। যে-বগির মধ্যে উঠেছি, সেই বগিতে দেখছি কতকগুলো ঘোষ ছানা দিতে এসেছিল কাটোয়া বাজারে। ওরা আমাকে দেখে বলল, ‘দাদা কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম, ‘কোথায় যাবো আমি নিজেই জানি না।’ ওরা বলল, ‘একটা গান শোনাবেন?’ আমি বললাম, ‘ভীষণ খিদে পেয়েছে। বলছেন যখন গাইছি।’ আমি পর পর পাঁচখানা গান গেয়ে শোনালাম। ওরা এর ওর কাছ থেকে আমাকে সাত টাকা তুলে দিল। টাকাটা নিতেই এত আনন্দ লেগেছিল তা লিখে বর্ণনা করা যায় না। পেটে খিদে আর হাতে এল পয়সা। ওরা কীর্নাহার লাভপুর নেমে গেল। এর পর গাড়ির অন্য বগিতে গিয়ে কেউ না বলতেই নিজে দাঁড়িয়ে দু’খানা গান করলাম। দেখছি গান শুনতে শুনতে কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে চার আনা আট আনা আমার হাতে দিতে লাগল। গাড়িতে বসে মিষ্টি দুটি খেয়ে জল খেলাম। তারপর দেখছি গাড়ি গিয়ে আমোদপুর স্টেশনে লেগে গেল, কেউ বলছে গাড়ি ওখানেই শেষ এর ওদিকে আর যাবে না। রাত্রিবেলাতে গাড়ি থেকে নেমে একটি হোটেলে গিয়ে দু’প্লেট ভাত খেয়ে টাকা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দু’চোখ গড়িয়ে জল পড়তে লাগল। বারবার মনে হচ্ছিল জীবনে কোনওদিন কারও কাছে কিছু চেয়ে খাইনি আর আজ আমাকে পেটের জ্বালায় গান গেয়ে ভিক্ষে করে খেতে হল? ঈশ্বর কি আমার ভাগ্যে এই লিখেছিলেন? আর যদি ভাগ্যে লেখা নেই তা হলে আমাকে ভিক্ষা করতে হল কেন? যাক যতই হোক আমি বাড়ি ফিরে যাব না। ঘুরে দেখব এই দেশটা কেমন। তাই ওখানেই ওই স্টেশনে রাত্রিটা কাটিয়ে সকালে বড় লাইনে গিয়ে ট্রেনে চাপলাম। গাড়ি চলল বর্ধমান, ব্যান্ডেল হয়ে হাওড়া। গাড়ির প্রতিটি বগিতে উঠি আর কেউ বললে বা না-বললেও ২/১ খানা গান গাইতে লাগলাম। বেশ কিছু পয়সা পেতে লাগলাম।