গোলাম শাহ একজন টিপিকাল ফকির। ধনমান তো নয়ই, এমনকী ‘একটুকু বাসা করেছিনু আশা’-ও তার মধ্যে নেই। আশ্চর্য।
মহম্মদ জালাল শাহ-র কথা—১
আমার নাম মহম্মদ জালাল শাহ। পিতার নাম মহম্মদ নায়েব শাহ। জন্ম দুবরাজপুরের ফকিরডাঙায়। বয়স এখন ১৪০৭ সালে বিয়াল্লিশ বছর।
আলম বাবা ডেকেছিলেন— তাই আমাদের পূর্বপুরুষরা এই স্থান বেছে নিয়েছিলেন। আমার দাদু, মানে বাবার বাবা, এখানে প্রথম আসেন। দাদুর নাম মহম্মদ দায়েম শাহ। আমার দাদুর বাবার নাম ছিল মহম্মদ ভ্রমর শাহ। থাকতেন বর্ধমানের চুরুলিয়ায়। আমার দাদুর জন্মমাটি চুরুলিয়া। তারপরে তিনি এখানে চলে আসেন। আমাদের বংশটা ফকিরের বংশ। ফকিরের সঙ্গে ঘোরা আর বাবাদের সেবাই আমাদের কাজ। বংশের ধারা অনুযায়ী আমি ফকির হয়েছি। ছেলেবেলা থেকেই আমার মনে এই ভাবনা ছিল। এই শিক্ষাদীক্ষার দিক দিয়ে আমি বাবার কাছে বায়েদ হয়েছি। ফকিরি সাধনা আর গানবাজনা করি।
আমার মন্তব্য
ফকিরদের স্বভাবের মধ্যে স্থায়ী বাস্তু এবং সেখানে বরাবর থাকার বাসনা কম থাকে। এর কারণ তাঁদের কোনও জমিজিরেত বা চাষবাস বড় একটা থাকে না। মাটি-জমি-ফসল মানুষের একটা বড় বন্ধন। দায়েম শাহ খুব বড় মাপের ফকির ছিলেন, ভ্রমর শাহ-র সন্তান। কিন্তু বর্ধমানের অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রাম থেকে দায়েম শাহ চলে এলেন দুবরাজপুরে আলম শাহ নামে এক উচ্চস্তরের ফকিরের আহ্বানে। তাঁকে ধরে এখন ফকিরডাঙায় চার পুরুষের ভিটে। কিন্তু ঠিক ভিটে নয়, কারণ জমিটা তো আলমবাবার। তাঁর সমাধিও ওখানে।
জালাল শাহ-র ক্ষেত্রে যেটা নতুনত্ব তা হল পিতার কাছেই ফকিরি দীক্ষা। পিতা থেকে পুত্র এমন ক্রমে ফকিরি দীক্ষা হয়ে থাকে। বাউলদের ক্ষেত্রে হয় না। তাদের তো প্রধানত জন্মরোধের সাধনা। শিষ্যই সন্তানের মতো। তাই শিষ্যসেবক না বলে শিষ্যশাবক বলেন অনেকে।
জালাল শাহ-র কথা—২
ফকিরি সাধনা একটা অন্য জগৎ। ওই ফকিরি জগতে থেকে তাকে পাওয়া যায়। তাকে পেতে গেলে কিছু ধ্যান-জ্ঞান, নাম-চর্চা আর ক্রিয়াকরণ করতে হয়। সে সাধনা নিরিবিলি জায়গায় হয়। যে খুঁজে নেবার নিরিবিলি জায়গা সে ঠিক খুঁজে নেবে।
ফকিরি মত বলে— সর্বজনের কাছে যাও। ফকিরি মত মানেই সর্বমত। এই মতটা ইসলাম ধর্মের মধ্যেই আছে।
ফকিরি মত হচ্ছে— আমরা নির্জনে আল্লাকে পেতে চাই, আর সেটা পেয়ে আলোকারী করতে চাই। কিছু জানা হল, কিছু মানুষে জানল, কিছু বাতনে থাকল— এইটা হচ্ছে আলোকারী। মৌলানা-মৌলবিরা সবসময়ে বলছে জাহির, আর আমরা চাইছি বাতন। আমাদের কিছু বাতনের দরকার, উনাদের জাহেরের দরকার।
ফকিরি সাধনার মূল কথা— নিজেকে চিনতে হবে, না-চিনলে কিছু হবে না। নিজের ভেতরটাকে আগে সাফ করতে হবে, তবে বাইরের সবকিছু সাফ দেখা যাবে। আমার ভেতরটা যদি সাফ না থাকে, ময়লা থাকে, তা হলে আমি সব ময়লা দেখব।
আর নূরের সাধনা হচ্ছে— আলোকারী। সেটা গোপন— বলতে নিষেধ আছে।
আমার মন্তব্য
ফকিরি জগৎ সম্পর্কে জালাল শাহ-র মন্তব্য পড়ে বোঝা কঠিন যে, এসব অনুভব তাঁর নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ না অন্যের মুখে শোনা। ‘তাকে পাওয়া যায়’ বা ‘তাকে পেতে গেলে’ বলতে উপাস্য বা আল্লাকে বোঝানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ‘ধ্যান-জ্ঞান, নাম-চর্চা’ কথাগুলি ধূসর। ফকিরি সাধনায় নাম-চর্চা ব্যাপারটা কী? এমন কথা আমরা আগে শুনিনি।
ফকিরি মত বলেছে সর্বজনের কাছে যাও, এমন কথায় কোনও বিরোধ নেই কিন্তু ‘এই মতটা ইসলাম ধর্মের মধ্যেই আছে’ মন্তব্য বিভ্রান্তিকর। ইসলামে এমন কথা কোথায় আছে?
‘আলোকারী’ শব্দটি বেশ নতুন, অন্য কোনও ফকিরের কাছে আগে শুনিনি। নূরের সাধনাও আলোকারী কি করে হবে? তার কিছু প্রকাশ্য কিছু গোপন কে বলেছে? এক কথায় বলা যায় চল্লিশোত্তর বয়সের জালাল শাহ সাধক হিসাবে খুব একটা অগ্রসর নন বলে মনে হয়। তাঁর কথাগুলি সাজানো এবং পুনরুক্তিতে ভরা।
জালাল শাহ-র কথা—৩
আমার জীবিকা গান। এ ছাড়া কিছু দেখাশোনা করি— অর্থাৎ কিছু কিছু ব্যাধির চিকিৎসা করি। আর কিছু করি না। লেখাপড়া হয়নি। অভাবের সংসার ছিল— বাবা পড়াতে পারেননি। কিছুদিন ইস্কুলে গিয়েছিলাম, কিছু হয়েছিল— কিন্তু সেটা খেয়ে ফেলেছি। আমার ছেলেমেয়েরা এখন সবাই ইস্কুলে যায়।
বর্তমানে আমার ছয় মেয়ে। এক ছেলে। দুটি ছেলে মারা গেছে। ছেলে এখনও ফকিরি লাইনে আসার মতো হয়নি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। …আমার স্ত্রীও ফকির বংশ। উনি বায়েদ হননি। আগে শাহ না হলে শাহের ঘরে মেয়ে যেত না, মেয়েও আসত না। তবে এখন ফকির সম্প্রদায়ের বাইরেও মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আমার বিয়ে একটাই।
আমার স্ত্রী বায়েদ না হয়েও ফকিরি সাধনায় আছেন। গোপনে কিছু বায়েদ আছে। গোপনে যদি মারফত পাওয়া যায়, তা হলে গোপনে বায়েদও পাওয়া যায়।
আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করি না। সেটা কিছু লোকের জন্য আছে। ফকিরি মতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ মানছে না।
আমার মন্তব্য
একজন অসহায় মানুষের সংলাপ কি এখানে শোনা গেল? অভাবের সংসারে বাবার সামর্থ্য ছিল না সন্তানকে পড়ানোর, লেখাপড়া হয়নি। অথচ জালাল শাহ মাত্র চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে আটটি সন্তানের জনক হয়েছেন, যার মধ্যে দু’জন অকাল প্রয়াত, বলা উচিত শিশু মৃত্যু। জন্মনিয়ন্ত্রণ তাঁদের ফকিরি মতে গ্রহণীয় নয়। অথচ মানুষটি বেশ আত্মসুখী।