বাউল সম্মেলনে বা সেমিনারে যেসব বাউল যোগ দেয়, তাদের রওনা হতে হয় বেশ সকালে। হেঁটে বাস রাস্তায় আসা, বাসের জন্য প্রতীক্ষা, তারপরে পৌঁছনো জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে। একটা কোয়ার্টার পাউরুটি, এক প্লেট ঘুগনি আর চা খেয়ে দুপুরের খুন্নিবৃত্তি। এবারে আরেকটা বাস ধরে উদ্দিষ্ট গ্রাম, যেখানে সম্মেলনের মঞ্চ আর বাউলদের থাকার জায়গা। সাধারণত কোনও ইস্কুলবাড়ির শ্রেণিকক্ষ, কিংবা নির্মীয়মাণ কোনও বাড়ির অসমান মেঝে। সেখানেই ঝোলা থেকে কম্বল বার করে ভূমিশয্যা, কিংবা খড়ের ওপর শতরঞ্চি, একটা গেলাস আর করোয়া কিস্তি, একতারা ও ডুবকি, কিংবা আনন্দলহরী। গাঁজার খুচরো সরঞ্জাম। পেটে সর্বগ্রাসী খিদে। তাই প্রথমেই টেবিলের সামনে লাইন দিয়ে সম্মেলনে নিজের নামটি পঞ্জিভুক্ত করে টিফিন আর ভোজের কুপন সংগ্রহ করে দ্রুত খাবার জায়গায় পৌঁছনো এবং অবেলায় খানিকটা ভাত ভাল কুমড়োর ঘ্যাঁট খেয়ে নেওয়া। তারপরে উঃ কী দুর্নিবার ঘুম। পথশ্রম, ক্লান্তি আর উদরপূর্তির নিশ্চন্ততা। গান বাজনা? সে পরে দেখা যাবে।
আমি খুব মমতা নিয়ে এই ক্ষুৎকাতর মানুষগুলিকে দেখি। আমার দেশের অনেকটাই উপেক্ষিত এক সম্প্রদায়। কুচকুচে কালো গায়ের রং। ঝুঁটি বাঁধা চুল এখন এলিয়ে দিয়ে, হয় নিবিড় নিদ্রাচ্ছন্ন, না হয় ম্লান মুখে বসে বসে বিড়ি টানছে। বাগদি, ডোম, দুলে, কুর্মি, কাহার, নমঃশূদ্র জাতের সব নিম্নবর্গীয় মানুষ। আমাদের এনটারটেনার। সারা বছরে কেমন করে তারা বাঁচে, কোথায় থাকে, কী খায়, কী তাদের সংকট কিছুই জানি না। তথ্য অফিসে ঘুরতে হয় তাদের। বিডিও সাহেবকে তৈলদান করতে হয়। যদি একটা প্রোগ্রাম পাওয়া যায়। বাড়িতে হা-অন্ন পরিবেশ, রুগণ্ খিন্ন জীবনসঙ্গিনী গেছে মাধুকরী করতে— বাড়িতে কয়েকটা অপোগণ্ড সন্তান।
ভাবতে গেলে কান্না পায়। জমিজিরেত নেই যে ফসল ফলাবে। কেউ কেউ পরের জমিতে মুনিশ খাটে কিংবা গাঁয়ের কারুর মেটে কুঁড়ে ঘর তৈরির সময় জোগাড়ের কাজ করে দু’-দশ টাকা পায়। কেউ ঘরামি, কেউ কীর্তনের পার্টির সঙ্গে খোল বাজায়। তবে ডাক এলে সবচেয়ে আগে বাউল। গোটা কয় পাথুরে মালা আছে সেগুলো গলায় গলিয়ে নেয়, হাতে লোহার বালা, পায়ে টায়ারের চটি। সম্মেলনে যাবার আগের বিকেলে ক্ষৌরি করিয়ে নেয়। গেরুয়া আলখাল্লা আর সস্তার ধুতি লুঙি করে পরা, মাথায় বাবরি কিংবা ঝুঁটি।
সম্মেলনে তাদের নাম পঞ্জিভুক্ত করে এক যুবক। বাঁধানো খাতায় নাম ঠিকানা লেখা হয়। তারপরে বুকে এঁটে দেয় সম্মেলনের ব্যাজ, হাতে দেয় একটা প্লাস্টিকের সস্তা কভার ফাইল। তার মধ্যে একটা ছোট প্যাড, ডট পেন ও ছাপানো কর্মসূচি। ফাইলের গায়ে মুদ্রিত আয়োজক সংস্থার নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর এবং তারিখ। মঞ্চে বসে দেখি দর্শকের আসনে জনপঞ্চাশ বাউল বসে আছেন, তাঁদের চোখে প্রত্যাশা, মনে কৌতূহল। ডেকরেটরের সংকীর্ণ চেয়ারে তাঁদের অস্বস্তি লাগে। এঁরা কেউ চেয়ারে বসার মানুষ তো নন। হাতে ধরা ফাইলটা ভারী বেমানান। নিরক্ষর হয়তো নন কেউ, কিন্তু প্যাড-পেনে সম্পর্ক তৈরি করা খুব কঠিন কাজ তাঁদের পক্ষে। বরং অনেক স্বচ্ছন্দ আনন্দলহরীতে টান মারতে বা দোতারাকে কথা বলাতে। গান গাইতে দিলে তো রক্ষা নেই— গগনবিদারী স্বরে সামনের মাঠ ভরতি হাজার কয় শ্রোতাকে একেবারে ভাসিয়ে দেবেন।
মঞ্চে বসে লোকায়ত জীবন বিষয়ে নির্বোধ ভি. আই. পি-দের ভাষণ শোনা কম শাস্তি নয়। আজকাল আবার নতুন হুজুগ উঠেছে গেরুয়া পোশাক পরে, একতারা দোতারা হাতে নিয়ে, কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মিছিল করে গ্রাম পরিক্রমা। গ্রামের প্রবেশ মুখে এবং ইতস্তত তোরণ ও পোস্টার। এখানে জাঁক করে বাউলদের সম্মেলন আর সেমিনার হচ্ছে তার জানানদারি। সম্বৎসর যে-মাইকম্যান বড় গাঁয়ের ভিডিও হলের ফিল্ম শো-র ঘোষণা করে ক্যাঁক ক্যাঁক করা কর্কশ আওয়াজে, তারই হাত-মাইকে আজ সম্মেলনের খবর। রাতে হামলে পড়বে পল্লিবাসী তাতে সন্দেহ নেই। গ্রামে প্রত্যক্ষ বিনোদন আর কই? কীর্তন বা কবিগান ক্কচিৎ হয়। যাত্রাপালার দল খুব ভেতরের দিকের গাঁয়ে আসে না। তাই সারাদিন ট্রানজিস্টারে হিন্দি গান বাজে। শহরে সিনেমা দেখে এসে গাঁয়ের দুয়েকটা ছোকরা ‘কুচ কুচ হোতা হায়’ আওড়াচ্ছে। তার মধ্যে বাউল গান? তার আকর্ষণ সাংঘাতিক।
এখানে একটা সত্যি কথা বলা দরকার। যাঁরা বলেই চলেছেন, গ্রাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অপ-সংস্কৃতির চাপে তাঁরা ঠিক বলছেন না। সব গ্রামই তো শহর-সংলগ্ন নয় এবং এখনও প্রচুর গ্রামে ইলেকট্রিকের পোস্ট যায়নি। তাই টিভি-র প্রভাব কথাটা অমূলক। কালেভদ্রে পুজোপার্বণে চাঁদা তুলে টিভি এনে ব্যাটারিতে ভিডিয়ো শো হয়। ক’জনই বা দেখে। কাজেই বেশির ভাগ গাঁয়েই এখনও শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে মদ্দ বাউল গানের আসরে আসে। বছরের পর বছর শ্রোতা বেড়েই চলেছে। নদিয়ার আসাননগরের কাছে কদমখালিতে ‘লালন মেলা’-য় গত দশ বছরে শ্রোতাদের সংখ্যা এত বেড়েছে যে তিন-তিনটে মঞ্চ করেও সামলানো যাচ্ছে না। তিনরাত গানের বিরাম নেই। লোকায়তের টান হল অমোঘ। যে-কোনও বাউলকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে এখন তাদের কত শ্রোতা। ঠিকই যে মাঝে মাঝে শ্রোতারা অসভ্যতাও করে। তবু উৎসাহ প্রবল।