খুব আগ্রহ ভরে হাতে নিয়ে পরম আবেগে তাকিয়ে থাকলাম। একটা ইতিহাস যেন সামনে তার পৃষ্ঠা খুলে দেখাল। কুবিরের লেখা পদ ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’ দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দিরে বসে গাইতেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই গীতিকারের হাজারো পদ আমার হাতে? আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে বসলাম, ‘এই খাতা আমাকে দেবেন তো?’
—না। খাতা তো দেবই না, এমনকী একটা গানও টুকতে দেব না।
—কেন?
—এহ খাতা দেখতে দিয়েছিলাম চাপড়ার ষষ্ঠী ডাক্তারকে। তিনি কখন আমার অজান্তে একখানা গান টুকে নিয়ে আকাশবাণীতে দিয়ে মোটা টাকা পেয়েছিলেন।
—সেকী? কী করে জানলেন? সেটা কোন গান?
—গানটা রেডিয়োতে প্রায় হয়— ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’, এই দেখুন আমাদের এই খাতায় রয়েছে ৪৩১ নং গান। দেখেছেন?
আমি কিছুতেই রামপ্রসাদকে বোঝাতে পারলাম না যে গানটা ওই খাতা থেকে টুকে ষষ্ঠী ডাক্তার দেননি আকাশবাণীতে— টাকাও পাননি। গানটা আছে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ ছাপার অক্ষরে। কিছুতেই বোঝানো গেল না অজ পাড়াগাঁর অশিক্ষিত সেই মোড়লকে। খাতা তিনি দিলেন না। পরে কীভাবে সেই খাতা হস্তগত হল, সব গান পড়লাম, যথেচ্ছ টুকে নিলাম, সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু আপাতত বলতে চাই, আগে ব্যাপারটা ছিল সাদাসাপটা— দেব অথবা দেব না। আর এখন গুরুঠাকুর গোটা কয়েক গান দেবেন বলে আমাকে ঘোরালেন, শিষ্যদের কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিলেন। বাউলদের কাছে কিছু পাওয়া আজকাল বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। তাদের দর এত বেড়ে গেছে।
বাউলদের সেমিনারে গেলে অবশ্য একেবারে উলটো ছবি। সেখানে দলে দলে প্রসাদভিক্ষুর মতো ভিড়। উদ্যোক্তাদের নাকালের একশেষ। সব জায়গায় একই অভিজ্ঞতা। হয়তো কোনও একজন বাউলকে পত্র মারফত নিমন্ত্রণ পাঠানো হল, এসে গেলেন দশজন। তাদের মধ্যে পাঁচজন যন্ত্র বাজাবেন, আর বাকি ক’জন এসেছেন সঙ্গ দিতে— আসলে দু’-তিন দিন ধরে থাকা খাওয়া ফ্রি, এদিকে বেড়ানোও হল। কিন্তু উদ্যোক্তাদের নাভিশ্বাস। একজন গায়ক আর পাঁচজন যন্ত্রীকে দিতে হবে অন্তত পঞ্চাশ টাকা করে, সেই সঙ্গে পাথেয় পঞ্চাশ টাকা, সাকুল্যে একশো। বাজেট বেড়ে গেল অনেক। আবার মঞ্চে উঠে আরেক কাণ্ড। নিমন্ত্রিত গায়ক নিজে না-গেয়ে প্রথমে পাঁচজন যন্ত্রীকে দিয়ে একটা করে বাউল গাওয়াবেন। তার মান যাই হোক। তারপরে নিজে গাইবেন। অনুষ্ঠানের ঘোষক পড়ে যান বিপাকে। সময়সীমা রাখাও হয়ে পড়ে কঠিন।
প্রধান উদ্যোক্তা ভদ্রলোক, হাতে ধরা ছোট ব্রিফকেস, ছোটাছুটি করে কূল পাচ্ছেন না। দরবিগলিত ধারায় ঘামতে ঘামতে আমার সামনে এসে, কোঁচার খুঁটে ঘাম মুছে বললেন, ‘নামেই বাউল সম্মেলন আর কী যেন বলেন আপনারা? হ্যাঁ সেমিনার… সেমিনার। নিকুচি করেছে কাজের।’
—কেন?
—টাকা দিচ্ছে মানে ম্যানেজ করেছি দু’জায়গা থেকে— পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র আর দিল্লি মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর থেকে। কড়াকান্তি হিসেব রাখতে হচ্ছে, ভাউচারসহ, বুঝলেন?
—অসুবিধে কী?
—আর্টিস্টদের পেমেন্ট করবে EZCC। তার ভাউচারে আর্টিস্টদের সই কিংবা টিপসই লাগবে তো। এখন ধরুন বাউল আর্টিস্ট আসার কথা পঁচিশজন, এসেছে পঁচাত্তরজন। টাকা তো দিয়েছে পঁচিশজনের। বাকি ক’জনের টাকা কোথা থেকে আসবে?
—এত বাউল আছে এ অঞ্চলে?
—না না, সবাই বাউল নাকি? এসে পড়েছে। একসেট গেরুয়া পোশাক আছে, গোটা দশেক গান জানে। ব্যস, তবে আর কী। এখন থাকতে দিতে হবে, গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবে পাঁচ-ছ’ বেলা, গাঁজা টানবে। যত্ত সব। মশাই, এর নাম লোকসংস্কৃতি? বাউলগানের উন্নয়ন? ধুস। ঘেন্না ধরে গেল। মানবসম্পদের টাকাই তো এখনও আসেনি। বুঝুন ঠেলা।
কিন্তু তবু এমন সম্মেলন আর সেমিনার বেড়েই চলেছে। আসলে একটা নতুন কিছু কর। যে সময়ে যে হুজুগ ওঠে। অথচ বাউল ফকিরদের ব্যাপারটা একেবারেই হুজুগে ছিল না। আমার দ্বিজপদ মাস্টারমশাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। বাউল ফকিরদের গান খুঁজে বেড়াচ্ছি খবর পেয়ে আমার বাড়ি এলেন গ্রাম থেকে সাইকেল ঠেলে। হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা তালিকা— তাতে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সাধক-বাউল আর ফকির-মিসকিনদের নাম, অন্তত পনেরোটা। বললেন, ‘এঁরা যে যে গাঁয়ে থাকেন তার নাম আর পথনির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। খুব কষ্ট হবে কোথাও কোথাও যেতে, অনেক হাঁটতে হবে, তবু যাবেন। এসব সাধক তো নিজেদের ডেরা বা আখড়া থেকে কোথাও যান না— আপনাকেই যেতে হবে। অনেক তত্ত্ব পাবেন, যা দশ বছর পরে বলবার মতো কেউ বেঁচে থাকবে না। তাঁরা হয়তো গায়ক নন, কিন্তু শিষ্য গায়কদের দিয়ে এমন এমন শব্দগান শোনাবেন যা কোনও পুঁথিপুস্তকে নেই, শুধু রয়ে গেছে পরম্পরায়, শ্রুতিতে আর গাহক সমাজে।’
মাস্টারমশাইয়ের কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য। যে-বর্গের সাধক গুরু আর ফকিরদের তখন সঙ্গ করেছি এখন তাঁরা বিরল প্রজাতি, না হয় অদৃশ্য। তবে এ কথাটাও ঠিক যে এমন মগ্ন সাধক তৈরি হয়ে ওঠার মতো আড়াল আজ তো আমরাও রাখিনি কোনও পল্লিতে। গ্রামপতনের ধুন্ধুমার কাণ্ডে সব ফৌৎ। সবই আজ বড় প্রকাশ্য। খয়েরবুনি আশ্রম সনাতনদাসের আখড়ায় যাচ্ছি, হঠাৎ পাশ দিয়ে সাঁ করে চলে গেল একটা টু-হুইলার। চালাচ্ছে জিন্স-পরা নব্যযুবা, ব্যাকসিটে এক বাউল। তার কাঁধে সঙিনের মতো উঁচিয়ে রয়েছে গেরুয়া ঘেরাটোপে একখানা দোতারা। তার মানে সন্ধ্যায় দূরান্তে কোথাও বায়না আছে… বাউল ছুটছে খেপমারা শহুরে গান-শিল্পীর মতো। রুজি রোজগার, বাঁচার তাগিদ, জনগণের চাহিদা।