অবশেষে বড়চাঁদঘরে পৌঁছই। সুবলসখার বাড়ি কে না চেনে। বিশেষত গতকাল সেই বাড়ির দীয়তাং ভুজ্যতাং মচ্ছবের খিচুড়ি এখনও সব গ্রামবাসীর পেটে রয়েছে। যাকেই জিজ্ঞেস করি হাঁ হাঁ করে নিশানা দেয়। কেউ কেউ সখেদে আগ বাড়িয়ে বলে, ‘দেখুন কপাল, মচ্ছব হয়ে গেল গতকাল, আর আপনি এলেন আজ? কাল এলে দেখতেন এলাহি ব্যাপার। বাউল গান শুনতেন রাতভোর। এখন তারা ঘুমোচ্ছে। এবারে খুব জমেছিল গানের আসর। দশজন গাহক এসেছিল, তার মধ্যে পাঁচজনের একটা দল এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। কাল এলেন না?’
আসিনি বলে আমার তেমন খেদ নেই। তারা ভাবল, আমি নিতান্ত বেরসিক। এসব দিবসী মচ্ছবে জাঁকজমক-হইহল্লা খাওয়া-দাওয়াটাই মুখ্য। রাতে গানের আসরটা নৈমিত্তিক, যেমন রাজনৈতিক সভার শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যাই হোক, সুবলসখার বাড়ির সামনে এসে মনে হল গতকাল যেন একটা ঝড় হয়ে গেছে। এখন সব শান্ত, শ্রান্ত ও নিদ্রারত। খোঁজখবর করতে ভিতরবাড়ি থেকে বিব্রত ও বিনীত সুবলসখা এলেন। মাঝবয়সি মানুষ— কোরা ধুতি, খালি গা, খালি পা, গলায় কঠি। বিব্রত হয়ে বললেন, ‘আসুন আসুন, বসুন। কিন্তু বসবেন বা কোথায়। সব ছত্রখান হয়ে আছে। এই একটা চেয়ার দে।’
কাঁঠাল কাঠের চেয়ারে উপবিষ্ট হলে সুবলসখা হাত কচলে বললেন, ‘ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় একটু বেলার দিকে আসবেন। সারারাত জেগে এখন সবাই ঘুমোচ্ছে। একেবারে আতান্তর অবস্থা। আপনাকে কী করে যে একটু সেবা দেব! ওরে কে আছিস, অন্তত একটু মুড়ি-চা দে। দেখুন দিকি, কাকেই বা বলি, সারাদিন সারারাত ভূতখাটুনি খেটে এখন সব ঘুমিয়ে কাদা। উঠবে সেই বারোটা-একটায়। দেখি, আমিই দেখি, গিন্নিকে ডাকি। বাড়িতে মান্যমান অতিথি বলে কথা…’
আমি তাঁকে নিরস্ত করে বলি, ‘ব্যস্ত হবেন না। আমি পলাশি বাসস্টপে নেমে চা খেয়ে নিয়েছি। চা-তেষ্টা নেই, খিদেও পায়নি। আপনার গুরু কোথায়? ঘুমোচ্ছো? আমার তো বলতে গেলে তাঁর কাছেই আসা।’
‘বিলক্ষণ, সে তো জানি’, সুবলসখা দাঁত বের করে বললেন, ‘নইলে কি এই অধম গরিবের বাড়ি আপনার পায়ের ধুলো পড়ে? গুরু গৌরবেই শিষ্যের মান বাড়ে। কিন্তু উনি তো নেই!’
—অ্যাঁ? সেকী? উনি যে আমাকে আজ আসতে বলেছিলেন।
—হ্যাঁ, বলেছিলেন ঠিকই। এসেছেন আপনি। গুরুবাক্য লঙ্ঘন হয়নি। কিন্তু উনি এসেছিলেন সাতদিন আগে। ওঁর কাছে ক’জন দীক্ষাশিক্ষা নিল এবার। ক’দিন থেকে তারপরে গতকাল সকালে মচ্ছব শুরু করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন সেই দত্তফুলিয়ায়। তবে হ্যাঁ, আপনার কথা বলে গেছেন। খাতির যত্ন করতেও আলাদা করে হুকুম দিয়ে গেছেন। এখন বিশ্রাম নিন। তারপরে দুপুরে মাছভাত খেয়ে, একটু জিরিয়ে…
—কিন্তু আমাকে আসতে বলে চলে গেলেন? আশ্চর্য তো! একাই চলে গেলেন?
—এটা কী বললেন? তা কি হতে পারে? সুবলসখার মতো শিষ্য তা হতে দিতে পারে? তাঁকে নিতে দত্তফুলিয়ার শিষ্যরা এসেছিল তিনজন। তাঁদের সঙ্গে গেলেন তিনি। বলে গেছেন সেখানে আপনাকে যেতে। সাতদিন থাকবেন সেখানে, মচ্ছব হবে, দীক্ষা হবে। যাবেন তো?
—হুঁ। যেতেই হবে। কালই যাব। ঠিকানা?
—ঠিকানা খুব সোজা। বাসে করে সোজা দত্তফুলিয়া বাজারে নামবেন। তারপরে বলবেন, কাত্তিক মণ্ডলের বাড়ি। বাস যেখানে দাঁড়াবে তার উত্তরদিকে, খুব নিকটে। গাঁয়ের মাথা। সবাই চেনে।
কথা শেষ করে সুবলসখা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, ‘আপনার হয়রানি হল। কিন্তু আসলে গুরু আপনার একটু পরীক্ষে নিলেন। ধৈর্যের পরীক্ষে, আগ্রহের, আন্তরিকতার। বুঝলেন তো?’
বুঝলাম। হালফিলের বাউল-গুরুর নিজের দর বাড়ানোর কেরামতি বুঝলাম আরও পরে, কার্তিক মণ্ডলের বাড়িতে পা রেখে। গুরুঠাকুর দিব্যি বসে আছেন শিষ্যশিষ্যা নিয়ে। পরিতৃপ্ত মুখচ্ছবি। আমাকে দেখে বললেন, ‘আসুন আসুন। কালকে খুব হয়রানি হল তো? আজ আসবেন সে খবর কালরাতে সুবলসখা পাঠিয়েছে। সেইজন্য আজ বেশ ক’জন শিষ্যকে ডেকে পাঠিয়েছি। এসে পড়বে এখুনি সব। আপনাকে দেখতে আসবে।’
—আমাকে দেখতে? কেন?
—আরে, আপনি একজন গবেষক অধ্যাপক। আমাদের নিয়ে কত খোঁজপাতি করছেন। গান জোগাড় করছেন। সেসব ওরা জানবে না?
হঠাৎ কথার মাঝে মুখ ফসকে একজন নির্বোধ শিষ্য বলে বসল, ‘তা ছাড়া ধরেন, আমাদের গুরুঠাকুরই কি কম? তাঁর কাছে আপনাদের মতো মানুষ আসছেন। একবার যাচ্ছেন বড়চাঁদঘর, আবার আসছেন এই দত্তফুলিয়ায়। আমাদের গুরু কত বড় ভাবুন তো? সেটা দেখাতেই আজ শিষ্যদের আনা হচ্ছে। এতে তেনার আরও কত শিষ্য হবে, তাই না বলো?’
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কার্তিক মণ্ডল বললেন, ‘এই কেষ্ট, তুই থামবি? এসব কথা তোকে কে বলতে বলেছে? বুঝিস কিছু?’
গুরুদেব নিমেষে সবাইকে হটিয়ে দিয়ে সাগ্রহে আমাকে ডেকে কাছে বসালেন। তারপর প্রসন্ন মুখে বার করলেন গানের খাতা, তাঁর ঝুলি থেকে। তার মানে, ধৈর্য অধ্যবসায়ের পরীক্ষায় আমি এবারে পাশ করলাম। একথা বোধহয় বলার দরকার নেই যে, খাতাখানা তাঁর কাছে বাঁকুড়াতেই ছিল— তবে আমাকে একটু খেলিয়ে নিলেন।
আগেই বলেছি এসব সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা। আগে এমন দর বাড়ানোও ছিল না, আমার এত ভোগান্তিও হত না। কারণ তখন ব্যাপারটা ছিল সরাসরি। যেমন ধরা যাক, ষাটের শেষে বা সত্তর দশকের গোড়ায় যখন আমি গানের সন্ধানে গ্রামে ঘুরতাম তখন নদিয়ার বৃত্তিহুদায় পেলাম কুবির গোঁসাইয়ের ঢাউস এক গানের খাতা। হাজারের ওপরে গান। গানের যিনি ভাণ্ডারী সেই রামপ্রসাদ ঘোষ সম্পন্ন চাষি গৃহস্থ। খুব আপ্যায়ন করলেন, খাওয়ালেন। এক পুরনো কাঠের সিন্দুক খুলে লাল শালুতে মোড়া গোঁসাইয়ের গানের খাতা বার করে মাথায় ঠেকিয়ে তারপরে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘এই খাতায় কুবির গোঁসাইয়ের গান সবই আছে। আমার পিতা দাসানুদাস ঘোষ, তাঁর পিতা রামলাল ঘোষের হাতের লেখায় এটা মূল খাতার নকল। দেড়শো বছর আগেকার পুঁথি।’