তবে এটা ঠিক যে, তিন চার দশকে সবকিছু খুব পালটে গেছে। সত্তরের দশকে যখন কিছু না জেনে, স্রেফ ব্যক্তিগত কৌতূহলে, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতাম গ্রামে গ্রামান্তে, তখন খুঁজে পেয়েছি যে পরিমাণ দরদি গায়ক ও আমগ্ন সাধক তা ক্রমশ কমে এসেছে। গ্রামের একেবারে ভেতরে কোনও গুরুপাটে গুরুপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা বা কোনও দিবসী উপলক্ষে আন্তরিক ভক্তসমাবেশ, শান্ত শুদ্ধ গানের আসর যতটা সহজে ও অন্তর্লগ্ন হয়ে উপভোগ করেছি, এখন সেখানে এসে গেছে জনতা ও কোলাহল। এসে গেছে অদীক্ষিত হঠকারী শ্রোতা আর শব্দদূষণের নিনাদ। আর-একটা উৎপাত হয়েছে গ্রামীণ মেলায় শহুরে মানুষের গাদাগাদি ভিড়। তিন দশকের মধ্যে চোখের সামনে বদলে গেল অগ্রদ্বীপ কিংবা ঘোষপাড়ার সুন্দর সুবিন্যস্ত মেলা। সারাদিন ধরে টু-হুইলার, টেম্পো, ট্রাক, ভ্যান, ম্যাটাডোর আর মোটর চেপে এসে পড়ছে অজস্র বিচিত্র রুচির মানুষ— নারীপুরুষ, এমনকী অর্ধশিক্ষিত গ্রামিক সমাজের লুম্পেনরাও। গানের আসরে বা আখড়ায় চলছে জেনারেটরের কর্ণভেদী আওয়াজ এবং তাকে ছাপিয়ে দুনে চৌদুনে তীব্র তালে সাউন্ড সিসটেমের পারদ উপরে তুলে বাউলের গান চলছে মাইকে। সে গানে কোনও নিবেদন নেই, ভক্তিনম্র চিত্তের প্রশান্তি নেই। আছে একজন গায়কের সঙ্গে আরেকজনের পাল্লাদারি, তবে তা গানের তত্ত্ব নিয়ে নয়, গানের পরিবেশনগত চমৎকৃতি ও লম্ফঝম্ফে।
গান পরিবেশনের এই সর্বাধুনিক জাঁকজমক শ্রোতাদের চাহিদাতেই ঘটেছে। ভাল গায়কও এখন অসহায়। শ্রোতারা গানের ফরমাশ করছে, মঞ্চে উঠে গিয়ে বাউলের জামায় এঁটে দিচ্ছে দশ, পঞ্চাশ এমনকী একশো টাকার নোট। সঙ্গে সঙ্গে আসরের উদ্যোক্তারা কর্ডলেস মাইকে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করছেন এই মহান সমঝদারি ও দানের গৌরব বার্তা। যেসব বাউল তত সুকণ্ঠ নন, অথচ ভাবগ্রাহী, গানের তত্ত্বের টানে ভেতর থেকে তুলে আনতে পারেন গহন গভীর অঞ্জলি, তাঁরা এসব উচ্চকিত আসরে কেমন যেন হতভম্ব মূক হয়ে পড়েন। আমার মতো বাউল আসরের বহুদর্শী শ্রোতার মন তখন আকুল হয়ে স্মৃতি হাঁটকায়। মনে পড়ে যায়, হয়তো শেওড়াতলায় অম্বউবাচীর মেলায় উপর্ঝরণ বৃষ্টির মধ্যে সারারাত শুনছি সামিয়েল আর জহরালির পাল্লাদারি গান, তত্ত্বের পর তত্ত্ব আসছে, শ্রোতারা উদ্দীপ্ত, খাড়া হয়ে বসছেন। কিংবা নসরৎপুরে চাঁদনি রাতে জাত-বৈষ্ণবের ভিটেয় সারারাত শুনছি সাধন বাউল আর ইয়ুসুফ ফকিরের গান। নিরাভরণ আসর, আকাশের চাঁদোয়া টাঙানো, খেজুরপাতার ঢালাও তালাই পেতে সমুৎসুক বিশ-পঁচিশজন শ্রোতা। কোনও উচ্চ মঞ্চ নেই, শ্রোতা আর গায়ক একই সমতলে। গানের ভাব শুধু উচ্চ থেকে উচ্চস্তরে উঠে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বায়িত হচ্ছে শ্রোতাদের চেতনালোক।
১.২ আয়নামহলের কথা
মাঝে মাঝেই নিমন্ত্রণ আসে বাউল সম্মেলন বা বাউলদের নিয়ে সেমিনারে যোগ দেবার জন্য। হয় কিছু বলতে হবে, নয়তো উদ্বোধন করতে হবে, না হয় সেমিনারেরই কোনও অংশ বা কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। আমি, সম্ভব হলে, অন্য কোনও ঝামেলা না থাকলে, এমন আহ্বান এড়াই না। তার দুটো কারণ। এক, একটা না-জানা জনপদ ও অঞ্চল, সেখানকার মানুষ ও নিসর্গকে জানা যায় ঘনিষ্ঠভাবে একদিন-দু’দিনের উষ্ণ সান্নিধ্যে। দুই, বাউলদের কাছাকাছি থেকে তাদের অনেক বেশি সংসর্গে আসা যায়। বিশেষ যাদের হালহদিশ আগে জানতে পারিনি, আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে, তাদের ঠিকানা-বিবরণ আমন্ত্রণ পেয়ে যাই। অবশ্য এ-বর্গের মানুষদের সঙ্গে সবচেয়ে ভাল করে ভাবের লেনদেন ও কথালাপ জমে ওঠে পরে, তাদের আস্তানায় কিংবা আখড়ায়। তবে সেখানে পৌঁছে হুট করে চলে আসার চেষ্টা করে লাভ নেই। থাকতে হবে একদিন দু’দিন। তাদের জীবনযাপন, তাদের সংলাপ, খাদ্য আর স্বভাবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাদের শিষ্য সেবকদের সঙ্গে ভাব করতে হবে। তাদের কাছে শুনতে হবে গুরুর নানা গুণগান, তাঁর মহিমার কত কিছু আখ্যান। গুরু মা-র কাছে বসে তাঁর আঁতের কথা শুনতে হবে। সত্যি মিথ্যে নানা কাহিনি। খুব গম্ভীর হয়ে শুনে যেতে হয়।
আজকাল বাউল গুরুরা নানা পরীক্ষা করেন। যেমন ধরা যাক, বাঁকুড়ার একজন তাত্ত্বিক বাউলের কাছে পৌঁছোলাম, থাকলাম একরাত। তাঁর কাছে পুরনো দেহতত্ত্ব গানের একটা খাতা আছে এ খবর জানতাম। সেটা চাইতে, কপি করে নিতে দেওয়ায় আপত্তি করলেন না, কিন্তু বলে বসলেন, ‘খাতাটা তো কাছে নেই। আছে এক শিষ্যের বাড়ি। বড়াচাঁদঘর গ্রাম চেনেন? আপনাদের নদে’ জেলায়। সেখানে আমার শিষ্য সুবলসখা সরকারের বাড়ি যাব অঘ্রান মাসের সাত তারিখে, মোচ্ছব আছে। সেদিন ব্যস্ত থাকব। আসুন পরের দিন আটই অঘ্রান। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে। গানের খাতাখানও পেয়ে যাবেন। পছন্দমতো গান টুকে নেবেন। তবে সে কাজে দু’দিন থাকতে হবে। অসুবিধে নেই, সুবল বড় গেরস্থ, মস্ত দালানবাড়ি, অঢেল জায়গা। এমনকী আপনাদের সেই ছ্যানিটারি পাইখানাও আছে, তবে কিনা টিউকল।’
উপায় নেই, শুনে যেতে হবে এহেন গুরুবাক্য। জানতে চাই গানের গুহ্য তত্ত্বকথা, সাধনার কথা, কিন্তু শুনে যেতে হয় অনর্গল— শিষ্যের ধনসম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, গুরুভক্তি এমনকী শৌচস্থানের আভিজাত্যের প্রসঙ্গ। তাই সই। এবারে একমাস পরে আটই অঘ্রান ভোরের বাসে চড়ে পৌঁছে যাই পলাশি, সেখান থেকে হাঁটা পথে বড়চাঁদঘর। অবশ্য ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে আর ক’জন প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে যাওয়া যেত। কিন্তু আমার পায়দল বেশি পছন্দ। পরিবেশটাকে অনুপুঙ্খ দেখা যায়।