বাউল আর শান্তিনিকেতন এক সুদীর্ঘ যুগলবন্দী এবং তার সূচনা রবীন্দ্রনাথ থেকে। বোলপুরের আশেপাশে বাউলদের পাড়া আছে। নবনীদাস প্রায়ই আসতেন গুরুদেবকে গান শোনাতে, কিছুদিন সেখানে বসবাসও করেছিলেন, কিন্তু কোথাও স্থিতু হওয়া তাঁর স্বভাবে ছিল না। তাঁর সময় থেকে শান্তিনিকেতনের কলাভবন আর সংগীত ভবনে আজও বাউলরা আসেন অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীদের গান শোনাতে— স্থানটি তাঁদের প্রিয়, কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সম্মাননীয়।
রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক উৎসাহ ছিল পৌষমেলাকে ঘিরে গড়ে তোলা গ্রামীণ সংস্কৃতির উজ্জীবন। প্রথম থেকেই সেখানে বাউলদের যাতায়াত ছিল। এখন তো সেখানকার বাউলের আসর এলিটিস্টদের সগর্ব উপস্থিতি ও শ্রোতারূপে অংশগ্রহণে খ্যাত ও প্রচলে পরিণত। পৌষমেলার মঞ্চে উঠে গান করতে পারা যে-কোনও বাউলের জীবনের বহুলালিত স্বপ্ন। পৌষমেলাতে এদেশের প্রচার মাধ্যম সবচেয়ে সক্রিয় দেখেছি। ভিডিও ক্যামেরা সর্বদা সচল সেখানে, দূরদর্শনের নানা চ্যানেল কলকাতা তথা বঙ্গবাসীদের সামনে উদ্ঘাটিত করে শান্তিনিকেতনের মঞ্চে বাউলগান ও নাচের রঙ্গ। এতসব ঘটনার যোগফল হল ‘বীরভূমের বাউল’ নামক কিংবদন্তির জন্ম ও বিকাশ।
তার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেখানকার গানের আসর পরিচালিত হয় বড়ই অবিন্যস্তভাবে। তবু পৌযমেলার মঞ্চ বাউলদের কাছে কতটা গর্বগৌরবের তা বোঝা যায় সনাতনদাস বাউলের মতো খ্যাতিমান প্রবীণতম শিল্পীর জবানিতে। তিনি স্বীকার করেন শান্তিনিকেতনই তাঁর স্বীকৃতি আর প্রতিষ্ঠার উৎস। সেখানে যাবার আগে সনাতনদাস বাউলকে,
কেউ চিনত না। এটাই তো বড় কথা। শান্তিনিকেতনে তো আমি বাংলা ’৫৮ সালে যাই;
৫৮-৫৯ সালে অ্যাটেণ্ড করি। দু’বছর হেঁটেই গিয়েছিলাম।
শান্তিদেব ঘোষ একবার বঙ্গসংস্কৃতিতে পাঠালেন। বললেন, সনাতন তোমাকে আরও লোক চিনতে পারবে; কলকাতায় যাও, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে গান করগা। তো সেই পরপর কয়েকবারই বঙ্গ সংস্কৃতিতে আমি যোগদান করি। শান্তিবাবু আমার অনেক সাহায্য করেছেন। একবার বেনারসে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গীয় সমাজে। এবং লণ্ডনের থেকে যখন খবর এলো যে, আমরা বাউল সংগীতের দল আনতে চাই— ওই শান্তিনিকেতনেই প্রথম খবর আসে। তো, আপনারাই নির্বাচন করে দেন যে, বাউল গান— সত্যিকার বাউল গান এবং নাচ কে ভালো পারে, এই সেই লোক।
শান্তিনিকেতন থেকে কণিকা ব্যানার্জি, শান্তিদেব ঘোষ এঁরা আমাকে ডাকলেন, যে, খাঁটি বাউল গান গাইতে হবে লণ্ডনে— সনাতন, তুমি পারবে? তা যদি আপনারা যোগাযোগ ঠিকমতো করতে পারেন, আমি যেতে পারি। এটা হল চুরাশি। তার আগে ঘুরে আসে পুণ্য আরও সব লোকজন নিয়ে।
লম্বা উদ্ধৃতি ব্যবহার করলাম এটা বোঝাতে যে এদেশের বাউলের উত্থানে, এমনকী সনাতনদাসের মতো গুণী শিল্পী, সাধক ও পারফরমারকেও অপেক্ষা করতে হয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এলিটদের সহায়তা পাবার জন্য। সেই সঙ্গে সংযোগ যথারীতি শান্তিনিকেতনের। তার আগে তাঁকে কেউ চিনত না। প্রথমে শান্তিনিকেতন, সেখান থেকে কলকাতার ভদ্রলোকদের সান্নিধ্য ও সমাদর, অবশেষে লন্ডনের খ্যাতিস্বর্গ! আরোহণের এই ক্রমিক বিন্যাসে গ্রামীণ বাউল গিয়ে পড়েন বিশ্বপরিচিতির বৃহৎ বৃত্তে। বাঁকুড়ার খয়েরবুনি আশ্রমের প্রত্যন্ত অবস্থান তাঁকে কি প্রার্থিত যশ ও ভাগ্য এনে দিত? একেই বলে স্থান-মাহাত্ম্য ও রবীন্দ্রমহিমার সদাব্রত। অথচ অজানা অচেনা এই সনাতনদাস এককালে পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছেছেন।
কিন্তু অনেকেই তো যেতে পারেননি— নিতান্ত ভৌগোলিক দূরত্বই তার কারণ। আর একটা কারণ লোকায়ত মানুষের সংকুচিত স্বভাব। নইলে উত্তরবঙ্গের বাউল বলহরি দাস তত্ত্বজ্ঞ বা গায়ক হিসাবে কম কীসে? মুর্শিদাবাদ-নদিয়ার প্রচুর ভাল গায়ক আছেন, তাঁদের হয়তো পৌষমেলা যাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনওদিন। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, এত যে বীরভূমের বাউলের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি, তাদের মধ্যে বড় মাপের বাউলতাত্ত্বিক কই? গত দুই দশকে অন্তত আমি তেমন কাউকে দেখিনি— আগে নিতাই খ্যাপা ছিলেন। এখন এই মুহূর্তে আমার দেখা যেসব উচ্চমার্গের বাউল তাত্ত্বিকের কথা মনে পড়ছে, তাদের মধ্যে সনাতনদাসের আদিবাস্তু খুলনা জেলায়, বলহরি দাসের জন্ম কর্ম উত্তরবঙ্গের পাবনায়, আজহার খাঁ ফকিরের বাড়ি নদিয়া জেলার গোরভাঙায়, আর নবাসনের হরিপদ গোঁসাই আদতে বরিশালের মানুষ। তা হলে বীরভূম নিয়ে এত হইচই কেন? তার কারণ মিডিয়ার প্রচার, কেঁদুলির জনসমাবেশের অতিরেক, শান্তিনিকেতনের পূত স্পর্শ। এদেশে একবার কোনও কিছু রটে গেলে তা হয়ে ওঠে চিরস্থায়ী। আমার বিচারে মুর্শিদাবাদ জেলা বাউল ফকিরদের বৈচিত্র্যে, গুরুত্বে এবং চলমানতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যাকে বলে ‘living tra-dition’ তার সবচেয়ে উজ্জ্বলন্ত নমুনা, কিন্তু তবু তার খ্যাতি নেই লোকসমাজে বা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানসে। কারণ জেলাটি কলকাতা থেকে অনেক দূরে, ইসলামি ঐতিহ্যের কারণে হিন্দু এলিটিস্টদের পক্ষে খুব রোচক নয় এবং সেখানকার গায়করা পূর্ণদাসের মতো বিদেশ দাপিয়ে আন্তর্জাতিক জয়জয়কার লাভ করেননি।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকিরদের বর্তমান অবস্থা এবং সামগ্রিক অবস্থানের সঠিক খোঁজখবর করতে গিয়ে ঘুরেছি নানা জেলার বহু রকমের জনপদ— শহর ও গ্রাম, নগরতলি। আলাদা করে একাধিকবার প্রবীণ সাধকদের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রথমত তাঁদের ডেরায় পরে মেলা মচ্ছবে, তারও পরে শিষ্যের বাড়ি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনুসন্ধানী গবেষকদেরও এসব সাধুগুরু নানাভাবে পরীক্ষা করে নিয়ে তবে ভেতরের কথা বলেন, সেই বিচারে আমাকেও যেন অর্জন করতে হয়েছে শিষ্যের মতো গুরু-নির্ভরতা ও প্রশ্নহীন আনুগত্য।