বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে আমাকে খোয়াড় থেকে বেরোতে হয়। কিন্তু আমাকে বেরুতে দেবে কি? খোয়াড়ের বাইরেই স্বাধীন মুক্ত সুইটজারল্যান্ড। তার জন্য ভিসার প্রয়োজন। আমার সেটা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখাই যাক না, কী হয় না হয়। সুকুমার রায় বলেছেন, উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়। সেইটে পড়ে আমার এক সখা ডাকপিয়নকে বলেছিল, আমার কোনও চিঠি নেই? কী যে বলছ? ফের খুঁজে দেখো। উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়।
খোঁয়াড়ের গেটে গিয়ে সেখানকার উর্দিপরা তদারকদারকে অতিশয় সবিনয় নিবেদন করলুম, স্যার! আমি কি একটু বাইরে ওই বাসস্ট্যান্ডে যেতে পারি?
আপনি তো ট্রানজিট না?
আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললুম, বাস-এ করে লুৎসের্ন থেকে আমার একটি বান্ধবী–
হায় পাঠক, তুমি সেই তদারকদারের প্রতিক্রিয়া যদি তখন দেখতে। বান্ধবী! বান্ধবী!! সেরতেমা (সার্টলি) চেরআনুতে (ইতালিয়ানে, সার্টলি) এবং তার জর্মনে জিষার জিয়ার (শিওর, শিওর) এবং সর্বশেষে, যদি না কুল পায়, মার্কিন ভাষায় শিয়োঁর, শিয়োঁ।
আমি জানতুম, আমি যদি বললুম, আমার বন্ধু আসছেন, সে বলত, নো। যদি বললুম আমার বিবি, উত্তর তদ্বৎ। যদি বলতুম, বৃদ্ধা মাতা তখনও হত না হয়তো কিঞ্চিৎ থতমত করে। কিন্তু বান্ধবী! আমার সাত খুন মাফ!
কলোনের নাম কে না শুনেছে। বিশেষ করে হেন ফ্যাশনেবল মহিলা আছেন যিনি কস্মিনকালেও প্রসাধনাৰ্থে ও-দ্য-কলোন– জর্মনের ক্যলনিশ ভাষার–কলনের জল ব্যবহার করেননি। বিশ্বজোড়া খ্যাতি এই তরল সুগন্ধিটির। ৪৭১১ এবং মারিয়া ফারিনা এই দুটিকেই সবচেয়ে সেরা বলে ধরা হয়। এ দেশেও কলোন জল তৈরি হয় কিন্তু ওটা বানাতে হলে যে সাত-আট রকমের সুগন্ধি ফুলের প্রয়োজন, তার কয়েকটি এদেশে পাওয়া যায় না– সর্বোপরি প্রাক প্রণালী তো আছেই। বিলেতেও কলোন জলের এতই আদর যে, হিটলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য চেম্বারলেন যখন সপারিষদ কলোন থেকে মাইল বিশেক দূরে গোডেসবের্গ-এর মুখোমুখি, রাইন নদীর ওপারে যে বাড়িতে ওঠেন, তার প্রতি ঘরে কলোন জল, কলোন জলের সুগন্ধ দিয়ে নির্মিত গায়ে মাখার সাবান, দাড়ি কামাবার সাবান, ক্রিম, পাউডার- বস্তৃত প্রসাধনের তাবৎ জিনিস রাখা হয়েছিল হিটলারের আদেশে। চেম্বারলেন এই সূক্ষ্ম বিদগ্ধ আতিথেয়তা লক্ষ করেছিলেন কি না জানিনে। কারণ তখন তার শিরঃপীড়া তার এ অভিসার তাঁর দেশবাসী কী চোখে দেখবে। তার আপন ফরেন অফিস যে সেটা নেকনজরে দেখছে না, সেটা তিনি জানতেন, কারণ ইতোমধ্যেই তারা একটা প্যারডি নির্মাণ করে ফেলেছে :
ইফ অ্যাট ফাস্ট ইউ কানট সাকসিড
ফ্লাই ফ্লাই ফ্লাই এগেন।
বলা বাহুল্য চেম্বারলেন ফ্লাই করে গিয়েছিলেন। আর আমি তো সেই গোডেসবের্গ-এর উপর দিয়ে কলোন পানে ফ্লাই করে যাচ্ছিই। সেই সুবাদে প্যারডিটি মনে পড়ল।
জুরিচে ফ্রিডির সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলুম। মনটা খারাপ হয়ে আছে।
কলোন শহরের সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের পরিচয়।
এখান থেকে প্রায় চৌদ্দ মাইল দূরে বন। সেখানে প্রথম যৌবনে পড়াশুনা করেছিলাম। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে করে এখানে আসা অতি সহজ। আমার একাধিক সতীর্থ কলোন থেকে বন ডেনিপ্যাসেঞ্জারি করত। তাদের সঙ্গে বিস্তর উইক এন্ড করেছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরটাকে দেখেছি।
সে-সব সবিস্তর লিখতে গেলে পাঠকের ধৈর্যচুতি হবে। আর লিখতে যাবই-বা কেন? জর্মন টুরিস্ট ব্যুরো যদি আমাকে কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ-বিদায় করত তবে না হয়–
যদি নিতান্তই কিছু বলতে হয়, তবে প্রথম নম্বর সম্বন্ধে বলি যে, সেটি আপনি চান কি না চান, কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। কলোনের বিরাট গগনস্পর্শী গির্জা। প্যারিসে যে রকম যেখানেই যান না কেন, অ্যাফ্যাল টাওয়ারটা এড়াতে পারবেন না, কলোনের এই কেথিড্রেলটির বেলাও তাই। তবে অ্যাফ্যাল স্তম্ভ বদখদ, কিন্তু কলোনের গির্জাচুড়ো তন্বী সুন্দরী। যেন মা-ধরণী উৗঁপানে দু বাহু বাড়ায়ে পরমেশ্বরকে তার অনন্ত অবিচ্ছিন্ন নমস্কার জানাচ্ছেন।
এ গির্জা আবার আমাদের কাছে নবীন এক গৌরব নিয়ে ধরা দিয়েছে।
বছর দুত্তিন পূর্বে কলোনবাসী প্রায় শ-দুই তুর্কি ও অন্যান্য মুসলমান ওই গির্জার প্রধান বিশপকে গিয়ে আবেদন জানায়, এ বছরে ঈদের নামাজ শীতকালে পড়েছে। বাইরে বরফ; সেখানে নামাজ পড়ার উপায় নেই। যদি আপনাদের এই গির্জের ভিতর আমাদের নামাজ পড়তে দেন, তবে আল্লা আপনাদের আশীর্বাদ করবেন। বিশপের হৃদয়কন্দরে কণামাত্র আপত্তি ছিল না কিন্তু এ শহরের লোক খ্রিশ্চান। তাদেরই বিত্ত দিয়ে, গরিবের কড়ি দিয়ে এ গির্জা সাত শো বছর আগে গড়া হয়েছে। এখনও ওদেরই পয়সাতে এ মন্দিরের তদারকি দেখভাল চলে। সে-ও কিছু কম নয়। এরা যদি আপত্তি করে? কিন্তু এই বিশপটি ছিলেন বড়ই সন্তপ্রকৃতির সজ্জন। এবং তার চেয়েও বড় কথা : সাহসী। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। মা-মেরি মালিক। তিনি সর্ব সন্তানের মাতা।
কিমাশ্চার্যমতঃপরম। তাঁর কাছে কোনও প্রতিবাদপত্রও এল না। খবরের কাগজেও এই অভাবনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বেরুল না। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!! অবিশ্বাস্য!!!