ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়ায় টেগোর শব্দ খুললে পাবেন, মাত্র রবীন্দ্রনাথের একটি অতি ক্ষুদ্র জীবনী। এবং তার জীবনীকার হিসেবে একমাত্র টমসনের নাম।
জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া সাইজে তার ইংরেজি অগ্রজের অর্ধেক মাত্র। তবু তার প্রথমেই পাবেন, টেগোর শব্দের অর্থ। অনুবাদ দিচ্ছি–
টিগোরে, আসলে ঠাকুর (Thakur) (সংস্কৃত ঠাকুর, প্রভু, সম্মতির প্রভু), পদবি (অষ্টাদশ শতাব্দীর আরম্ভ থেকে), বর্তমানে পারিবারিক নাম। এ পরিবার দ্বাদশ শতাব্দীতে অযোধ্যা হতে বঙ্গে আগত ব্রাহ্মণদের বাঁড়ুয্যে পদবিধারী। পূর্বপুরুষ সংস্কৃত নাট্যকার ভট্টনারায়ণ (অষ্টম শতাব্দী)।
এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনার জন্য তার পর একখানি পুস্তকের উল্লেখ আছে। নাম আর্ষিত ফুর রাসেন উনটু গেজেলশাফটস্-বিয়োলগি অর্থাৎ আর্কাইভ ফর রেস অ্যান্ড বায়োলজি অব সোসাইটি- জাতি এবং সামাজিক জীববিদ্যার দলিল-দস্তাবেজ।
এর পর আছে, অবনীন্দ্রনাথের জীবনী, তার পর দেবেন্দ্রনাথের এবং বিস্তৃত বিবরণের জন্য তাঁর আত্মজীবনীর উল্লেখ আছে।
বর্ণানুক্রমে সাজানো বলে সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথের জীবনী। অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করে লেখক বলছেন, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তাকে যে স্যার উপাধি দেওয়া হয়, সেটা তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরে রক্তগঙ্গা (জর্মনে বুট-বাট= ব্ল-বাথ) প্রবাহিত হওয়ার পর বর্জন করেন।১ এবং সর্বশেষে যে জীবনীগুলোর উল্লেখ আছে সেটি লক্ষণীয়।
(i) H. Meyer-Benfey : Rabindranath Tagore (1921); (2) P. Notorp : Studen mit Rabindranath Tagore (1921); (3) W. Graefe : Die Weltanschauung Rabindranath Tagores (1930); (4) R. Otto : Rabindranath Tagores Bekenntnis (1931); (5) M. Winternitz : Rabindranath Tagore Religion und Weltanschauung des Dichters (Prag 1936) অতি উৎকৃষ্ট; এর বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত (লেখক) (6) Marjorle Sykes : Rabindranath Tagore (1943); (7) E. J. Thompson : Rabindranath Tagore, Poet and dramatist (1948); (8) J. C. Ghosh : Bengali Literature (1948).
পাঠশালে গুরুমশায়ের কাছে প্রথম যে চড় খেয়েছিলুম সেটা আজও ভুলিনি। স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসছে সে দৃশ্যটা কিন্তু তার কথা এখন ভাবতে গেলে কেমন যেন সদয় হাসি পায়। অথচ বার্লিনে নেমে যে চড় খেয়েছিলুম সেটা তো ভুলিনি বটেই, তদুপরি এখনও সেটা স্বপ্নে দেখি এবং এক গা ঘেমে জেগে উঠি। প্রত্যেকটি ঘটনা ঠাস ঠাস করে টাইপ রাইটারের মতো গালে চড় মেরে যায় এবং তার প্রত্যেকটি যেন মনের সাদা কাগজের উপর লাল রিবনের কালিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে।
প্রথমবারের অভিজ্ঞতা। কাবুল থেকে দেশ হয়ে বার্লিন পৌঁছেছি। কাবুলে অনেক মার খেয়ে অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু সেগুলো তো এখানে কোনও কাজে লাগবে না। বার্লিন মারাত্মক মডার্ন শহর। এখানে চলাফেরার কায়দা-কেতা একদম অজানা।
প্লাটফর্মে অসহায় আমি দাঁড়িয়ে। রবিনসন ক্রুশো নিশ্চয়ই এতখানি অসহায় অনুভব করেননি। তিনি যে ভুলই করুন না কেন, তার জন্য তাঁকে কারও কাছ থেকে চড় খেতে হবে না, জেলে যেতে হবে না। তিনি উদোম হয়ে ঘুরে বেড়ালেও কেউ কিছু বলবে না। মার্সেলেস বন্দরে রাস্তার বাঁ দিকে চলতে গিয়ে প্রথম ধমক খেয়েছি। ফরাসি মাস্টার বলে দিয়েছিলেন বটে, কন্টিনেন্টে কিপ টু দি রাইট–আমাদের দেশে খাল-বিলেও মাঝিরা চিৎকার করে একে অন্যকে তম্বি করে আপন ডা-ই-ন! কিন্তু বন্দরের ধুন্ধুমারের ভিতর কি অতশত মনে থাকে?
স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যাঁকে মার্সেলেস থেকে তার করেছিলুম, তিনি সে তার পাননি কিংবা সেগুলো আর বলে দরকার নেই। ভুক্তভোগীই জানেন, তখন সম্ভব অসম্ভব কত কারণই মনে আসে। আমি আসছি জেনে সে আত্মহত্যা করেনি তো ইস্তেক।
পোর্টারটি কিন্তু দেখলুম আমাদের কুলির মতো ঘড়ি ঘড়ি তাড়া লাগালে না। আমার সেই বিরাট মাল-বহর– পরে দেখলুম বার্লিনে তার পনেরো আনাই কাজে লাগে না ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে নির্বিকার চিত্তে পাইপ টানছে।
জর্মন ভাষা যে একেবারে জানিনে তা নয়। ঝাড়া পাঁচটি বচ্ছর উত্তম উত্তম গুরুর কাছে শান্তিনিকেতনে সে ভাষার ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করেছি। কিন্তু বার্লিনের এই জীর্ণ শীতের সঝে কোন জর্মন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিদেশির মুখে তারই মাতৃভাষার শব্দরূপ– তা-ও ভুল উচ্চারণে– শুনতে যাবে? হাওড়া স্টেশনে যদি কাবুলিওলা কোন বঙ্গসন্তানকে দাঁড় করিয়ে তার খাস কাবুলি উরুশ্চারণ সহযোগে লিটু, লঙ, আশিলিঙ শোনাতে চায় তবে অবস্থাটা হয় কী রকম?
বুদ্ধি করে ট্রেনে একটি ফরাসি-জাননেওলি মহিলাকে শুধিয়ে নিয়েছিলুম, স্টেশনে মালপত্র রাখার জায়গাটাকে জৰ্মনে কী বলে? তিনি বলেছিলেন,
Gepaeckaufbewahrungsstelle
!!!
প্রথম ভেবেছিলুম তিনি মস্করা করছেন। তাই আমি সেটা টুকে নিয়েছিলুম। মাসখানেক পরে বার্লিনে গোছগাছ করে বসার পরে শব্দটিকে হামানদিস্তে দিয়ে টুকরো টুকরো করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তার অর্থ বের করেছিলুম। উপস্থিত সেই চিরকুট টুকুন পোর্টারের হাতে দিলুম। সে একটা হুম শব্দ করে গুম গুম করে ঠেলাগাড়ি চালিয়ে এগোল। আমি মেরির লিটল ল্যামের মতো পিছনে পিছনে চললুম।