কাতেরিনা অবাক হয়ে ভাবছিল, এই হোল্কা মোটকা বেড়ালটা ঘরে ঢুকলই-বা কী করে আর এলই-বা কেন? কাতেরিনা আবার আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, আমি খানিকটে সর জানালার চৌকাঠের উপর রেখেছিলুম; এই পাজি হুলোটাকে যদি তাড়া লাগিয়ে খেদিয়ে না দিই তবে সে বেবাক সর চেটে মেরে দেবে। বেড়ালটাকে পাকড়ে ধরে বাইরে ফেলে দেবার সে যতই চেষ্টা করতে লাগল ততই সে যেন ঠিক কুয়াশার মতো তার আঙুলের ভিতর দিয়ে বার বার গলে যেতে লাগল। বোবায় ধরা দুঃস্বপ্নের ভিতরও কাতেরিনা মনে মনে তর্ক করতে লাগল, তা সে যাকগে, কিন্তু এই হুলো বেড়ালটা এখানে আদৌ এল কোত্থেকে? আমাদের শোবার ঘরে তো কস্মিনকালেও কোনও হুলো বেড়াল ছিল না; তবু, দেখ, কীরকম একটা ইয়া লাশ এখানে ঢুকে পড়েছে! আবার কাতেরিনা তাকে পাকড়াবার চেষ্টা করল, আবার বেড়ালটা হাওয়া হয়ে গেল। মনে তার ধোঁকা লাগল, বা রে! এটা তবে কী? দেখি ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে- এটা কি আদপেই হুলো বেড়াল নাকি? হঠাৎ এক দারুণ ভয়ের বিভীষিকা যেন তার সর্বাঙ্গ চেপে ধরে কুলে নিদ্রা আর ন্দ্রিালু ভাব খেদিয়ে দিল। কাতেরিনা ঘরের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখে বেড়ালটার নামগন্ধও নেই। শুধু তার সুদর্শন সেরগেই পাশে শুয়ে তার বুকের মাঝখানে আপন গরম মুখটি খুঁজে দিয়েছে।
কাতেরিনা বিছানায় উঠে বসল; চুম্বনে চুম্বনে সে সেরগেইকে আচ্ছন্ন করে দিল। তার আদর সোহাগ যেন শেষ হতেই চায় না। তার পর হাঁসের বুকের নরম পালকের আলুথালু বিছানাটাকে ছিমছাম করে দিয়ে বাগানে চা খেতে চলে গেল। সূর্য তখন অস্তাচলে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে আর উষ্ণগর্ভা পৃথিবীর উপরে নেমে আসছে অপূর্বসুন্দর, সম্মোহনী সন্ধ্যা।
ফুলে ফুলে ঢাকা আপেলগাছের তলায় রাগ-এর উপর বসল কাতেরিনা চা খেতে। আকসিনিয়াকে বলল, বড্ড বেশি ঘুমোতে ঘুমোতে অবেলা হয়ে গেল। তার পর বাসন পোছার কাপড় দিয়ে একটা পিরিচ পুঁছতে পুঁছতে রাঁধুনীকে শুধালো, আচ্ছা, বল তো, এসবের অর্থ কী আকসিনিয়া, সোনা?
কী? কিসের কী অর্থ, মা?
ওটা কিন্তু নিছক স্বপ্ন ছিল না। কোথাকার কোন এক হুলো বেড়াল বার বার শুধু আমার গা বেয়ে উঠছিল। আর-পাঁচটা বেড়ালের মতো হুবহু জলজ্যান্ত বেড়াল। এর অর্থ কী?
এসব আপনি কী বলছেন?
সত্যি বলছি, একটা বেড়াল আমার গা বেয়ে উঠছিল।
কীভাবে বেড়ালটা তার গা বেয়ে উঠছিল সেসব কথা তখন কাতেরিনা তাকে বলল।
আপনি আবার ওটাকে আদর করতে গেলেন কেন?
তা, বাপু, আমাকে জিগ্যেস করছ কেন? আমি নিজেই জানিনে, ওটাকে আদর করলুম কেন।
সত্যি সত্যি, বড়ড়ই তাজ্জব ব্যাপার এটা!
আমার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা নেই। এটাতে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে কেউ না কেউ আপনার শত্রুতা না করে ছাড়বে না। কিংবা ওই ধরনেরই কিছু একটা হবে।
হ্যা। কিন্তু ঠিক কী?
ঠিক ঠিক হুবহু কী হবে সেটা কেউই আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না, –ঠিক ঠিক, হুবহু কেউই পারবে না, সোনা মা, শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, একটা না একটা কিছু ঘটবেই ঘটবে।
কাতেরিনা বলল, আমি ঘুমে বার বার শুক্লপক্ষের ফালি চাঁদ দেখছিলুম, আর সেই বেড়ালটা।
ফালি চাঁদ?– তার অর্থ বাচ্চা হবে।
কাতেরিনার মুখ লাল হয়ে উঠল।
সেরগেইকে কি তোমার কাছে এখানে নিচে পাঠিয়ে দেব, মা-মণি?– কলে-কৌশলে ইঙ্গিত দিলে আকসিনিয়া। আসলে কাতেরিনার বিশ্বাসের পাত্রী হওয়ার জন্যে তার প্রাণ যেন বেরিয়ে আসছিল।
হ্যা, সে-ও তো বেশ কথা! ওকে গিয়ে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে চা দেবখন।
আমিও তাই বলি– এখানে পাঠিয়ে দিই। আকসিনিয়াই প্রস্তাবটার নিষ্পত্তি করে দিল। তার পর পাতিহাঁসের মতো হেলেদুলে বাগানের গেটের দিকে চলল।
কাতেরিনা সেরগেইকেও বেড়ালটার কথা বলল।
সেরগেই বলল, কিছু না, স্রেফ দিবাস্বপ্ন।
কিন্তু সেরেজা, আমি এর আগে এরকম দিবাস্বপ্ন কখনও দেখিনি কেন, সেইটে বুঝিয়ে বল।
আগে কখনও হয়নি, এই প্রথম হল, এরকম জিনিস তো নিত্যি নিত্যি হচ্ছে। এমন দিনও ছিল যখন আমি শুধু তোমাকে আড়চোখে একটুখানি দেখে নেবার সাহস করতে পারতুম না, আর তোমার জন্য আপন দুঃখে গুমরে মরতুম। আর এখন দেখ, সবকিছু বদলে গিয়েছে। এই যে তোমার শ্বেতশুভ্র দেহ– এর সমস্তটি এখন আমার।
সেরগেই কাতেরিনাকে বুকে ধরে আলিঙ্গন করল, তার পর শূন্যে তুলে ঘুরিয়ে নিয়ে কৌতুকভরে তাকে নরম কম্বলের উপর ফেলে দিল।
কাতেরিনা বলল, ওগো, আমার মাথা ঘুরছে। সেরেজা, এই দিকে এসো। আমার পাশে এসে বস।– সেরগেইকে ডাক দিয়ে কাতেরিনার অলস রভসার মৌন ইঙ্গিত দিয়ে শুয়ে পড়ল।
শুভ্র কুসুমদামে আচ্ছাদিত আপেলগাছের তলায় বেপরোয়া রসের নাগর হামা দিয়ে এসে কাতেরিনার পায়ের কাছে বসল।
আমাকে পাবার জন্য তুমি কাতর হয়েছিলে, না? সেরেজা?
তুমি যদি শুধু জানতে কতখানি কাতর হয়েছিলুম!
সেটা কীরকম ছিল, আমাকে বুঝিয়ে বল।
সে আমি কী করে বুঝিয়ে বলব? অপূর্ণ আকাক্ষার মর্মবেদনায় তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া কি কেউ কখনও বোঝাতে পারে? আমার ছিল সেই।
তা হলে, সেজো, তুমি যে নিজেকে তিলে তিলে মেরে ফেলছিলে সেটা আমি অনুভব করলুম না কেন? লোকে তো বলে সেটা নাকি অনুভব করা যায়।
সেরগেই নীরব থেকে এ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।
তা হলে তুমি হরদম গান গাইছিলে কী করে, যদি আমার জন্য এতখানি তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে মরছিলে? কিছু ভয় নেই। আমি সব জানি। তুমি যে উঁচু বারান্দায় গান গাইতে সে তো আমি শুনতে পেতুম।–কাতেরিনা সেরগেইকে আদর করতে করতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে যেতে লাগল।