ওকে যেতে দাও, বাবা। আমি আমার বিবেক সাক্ষী রেখে শপথ করছি আমরা এখনও কোনও পাপাচার করিনি।
পাপাচার করেনি! ওহ! বলে কী?– বুড়ো যেন আর কিছু না করতে পেরে শুধু দাঁত কিড়িমিড়ি দিতে লাগল। এ ক-রাত্তির ধরে তোমরা উপরে কী করে সময় কাটাচ্ছিলে? দুজনাতে মিলে তোমার স্বামীর বালিশের ফেঁসো ফুলিয়ে ফালিয়ে তার জন্য জুৎসই করে রাখছিলে।– বুড়ো ব্যঙ্গ করে উঠল।
কাতেরিনা কিন্তু নাছোড়বান্দা; সেই এক বুলি ক্রমাগত বলে যেতে লাগল, ওকে ছেড়ে দাও, ফের আবার ওকে ছেড়ে দাও।
বুড়ো বরিস বলল, এই যদি তোর বাসনা হয় তবে শুনে নে; তোর স্বামী ফেরার পর তোকে বাইরের ওই আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে আমরা দুজনাতে আপন হাতে চাবুক মারব–সতী সাধ্বী রমণী কি না তুই! আর ওই ব্যাটাকে নিয়ে কী করা হবে শুনবি–ইতর বদমাইশটাকে কালই পাঠাব জেলে!।
এই ছিল বরিস তিমোতেইচের সিদ্ধান্ত; শুধু এইটুকু বলার আছে যে, সে সিদ্ধান্ত কখনও কর্মে রূপান্তরিত হল না।
০৫. ব্যাঙের ছাতা আর গমের পরিজ
০৫.
সেই রাত্রে বরিস ব্যাঙের ছাতা আর গমের পরিজ খেয়েছিল। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তার বুক-জ্বালা আরম্ভ হল। হঠাৎ তলপেটে তার অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হতে লাগল। খানিকক্ষণ পর বমির চোটে যেন তার নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতে লাগল এবং ভোরের দিকে সে ভবলীলা সংবরণ করল; হুবহু যেরকম গুদামবাড়ির ইঁদুরগুলো মারা যায়। এদেরই উপকারার্থে কাতেরিনা আপন হাতে একরকমের মারাত্মক সাদা গুঁড়ো মাখিয়ে খাবার তৈরি করত– এ গুড়োটা কাতেরিনার হেফাজতেই থাকত।
কাতেরিনা তার আপন সেরগেইকে বুড়োর গুদামঘর থেকে মুক্ত করে নিয়ে সক্কলের চোখের সামনে, কণামাত্র লজ্জা-শরম না মেনে, শৃশুরের চাবকানো থেকে সেরে ওঠার জন্য। তাকে তার স্বামীর বিছানায় আরাম করে শুইয়ে দিল। ওদিকে কালবিলম্ব না করে শ্বশুরকে খ্রিস্টধর্মের আচার-অনুষ্ঠানসহ গোর দেওয়া হল। অবশ্য লক্ষণীয় বলে মনে হতে পারে, কারও মনে কোনও সন্দেহের উদয় হয়নি; বরিস তিমোতেই যদি মরে গিয়ে থাকে তবে, যা, সে নিশ্চয়ই মারা গেছে ব্যাঙের ছাতা খেয়ে আর, ওরকম কত লোক তো ব্যাঙের ছাতা খেয়ে আকছারই মারা যায়। ছেলের জন্য অপেক্ষা না করেই বুড়ো বরিসকে সাত-তাড়াতাড়ি গোর দেওয়া হয়েছিল, কারণ বছরের ওই সময়টার ভাপসা গরম পড়ে*[* ফলে মৃতদেহ খুব তাড়াতাড়ি পচতে আরম্ভ করে। অনুবাদক।] আর যে লোকটা খবর নিয়ে গিয়েছিল সে জিনোভিই বরিসিচকে মিলে পায়নি। ষাট মাইল আরও দূরে সে সস্তা কিছু জঙ্গলা জমির খবর পায় এবং সেটা দেখতে সে ওইদিকে চলে গিয়েছিল। যাবার সময় সে আবার কাউকে পরিষ্কার করে বলে যায়নি ঠিক কোন জায়গায় যাচ্ছে।
সব ব্যবস্থা করে নেবার পর কাতেরিনা একদম বে-লাগাম হয়ে গেল। ভীরু সে কোনও কালেই ছিল না, কিন্তু এখন তার মনের ভিতর কী খেলছে তার কোনও পাত্তাই কেউ পেল না। পুরো পাক্কা হিম্মতভরে সে চলাফেরা করতে লাগল, বাড়ির সর্বপ্রকার কাজকর্মে ঠিকমতো তদারকি করল এবং সেরগেইকে এক লহমার তরে চোখের আড়াল হতে দিত না। বাড়িতে যারা কাজ করত তারা সবাই এসব দেখে তাজ্জব; কিন্তু কাতেরিনা দরাজ হাত দিয়ে প্রত্যেককে বশীভূত করার তত্ত্বটি বিলক্ষণ জানত, সর্ববিস্ময় তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
যে যার আপন মনে অনুমান করল, কীঠাকুরানী আর সেরগেইয়ের ভিতর চলছে বেলেল্লাপনা– ওই হল গিয়ে মোদ্দা কথা! এখন তো ওটা তারই শিরঃপীড়া, আমাদের কী, আর জবাবদিহি তো করতে হবে একলা তাকেই।
ইতোমধ্যে সেরগেই তার স্বাস্থ্য, তার নমনীয় মাধুর্য পুনরায় ফিরে পেয়েছে আর বীরদের সেরা বীরের মতো আবার কাতেরিনার উপরে শিকারি পাখির মতো চক্কর খেতে শুরু করেছে। আবার আরম্ভ হয়েছে তাদের আনন্দময় দিন-যামিনী! কিন্তু কালবেগ শুধু ওদের দুজনার তরেই তো আর এগিয়ে যাচ্ছিল না। ওদিকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর স্বামী হিসেবে বিড়ম্বিত জিনোভিই বরিসি দ্রুতবেগে আপন গৃহমুখে ধাবিত হয়েছে।
.
০৬.
আহারাদি শেষ করা হয়েছে। বাইরে তখনও দুর্দান্ত গরম আর চটপট যেদিক-খুশি সেদিকে মোড় নিতে ওস্তাদ মাছিগুলোর উৎপাত অসহ্য হয়ে উঠেছে। কাতেরিনা তার শোবার ঘরের জানালার খড়খড়িগুলো বন্ধ করে তার উপরে ভিতরের দিকে একখানা ফ্ল্যানেলের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে বণিক সম্প্রদায়ের সমাদৃত উঁচু খাটে সেরগেইকে নিয়ে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়েছে। কাতেরিনা ন্দ্রিা জাগরণে আসা-যাওয়া করছে, কিন্তু নিদ্রাই হোক আর জাগরণই হোক, তার মনে হচ্ছিল যেন তার মুখ ঘামে ভেসে যাচ্ছে আর প্রত্যেকটি নিশ্বাস অত্যন্ত গরম আর অতিশয় কষ্টের সঙ্গে ভিতরে যাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল ঘুম থেকে উঠে বাইরের বাগানে বসে চা খাবার বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আপ্রাণ শত চেষ্টাতেও সে কিছুতেই উঠে বসতে পারছিল না। শেষটায় রাঁধুনী এসে দরজায় টোকা দিল।
প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সে পাশ ফিরল, তার পর একটা হুলো বেড়ালকে আদর করতে লাগল। কারণ ইতোমধ্যে একটা খাসা সুন্দর, পুরোবাড়ন্ত, …র মতো মোটাসোটা, খাজনা উশুলের পেয়াদার মতো বিরাট একজোড়া গোঁফওলা বাদামি রঙের বেড়াল এসে তার আর সেরগেইয়ের মাঝখানে গা ঘষতে আরম্ভ করেছে। কাতেরিনা তার ঘন লোমের ভিতর আঙুল চালিয়ে তাকে আদর করতে লাগল আর বেড়ালটাও তার ভোতা মুখ আর বোঁচা নাক দিয়ে কাতেরিনার কঠোর-কোমল বুকে চাপ দিচ্ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সোহাগের ঘর ঘরর শব্দ ছেড়ে যেন গান গাইছিল– কাতেরিনার প্রেম নিয়ে, অতি কোমল মোলায়েম সুরে।