সমস্ত ঘরে নীরবতা– শুধু শিয়রের খাড়া তক্তাতে ঝোলানো কাতেরিনার স্বামীর পোশাকি ট্র্যাকঘড়িটি টিকটিক করে যাচ্ছে; কিন্তু সে আর কী বাধা দেবে!
যাও। আধঘণ্টা পরে কাতেরিনা সেরগেইয়ের দিকে না তাকিয়েই আলুথালু চুল ছোট্ট একটি আয়নার সামনে ঠিক করতে করতে বলল।
এখন আর আমি যাব কেন? বিশ্ব-সংসার খুঁজলেও তো এখন আর কোনও কারণ পাওয়া যাবে না। সেরগেইয়ের কণ্ঠে এখন উল্লাসের সুর।
শ্বশুরমশাই বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দেবেন যে।
কী বললে, আমার পরানের মণি? এতদিন ধরে তুমি কি শুধু তাদেরই নিয়ে নাড়াচাড়া করেছ যারা রমণীর কাছে পৌঁছতে হলে দরজা ভিন্ন অন্য কোনও পথ জানে না? আমার ভিন্ন। ব্যবস্থা। তোমার কাছে আসতে হলে, তোমার কাছ থেকে যেতে হলে আমার জন্য বহু দরজা খোলা রয়েছে। ব্যালকনির খুঁটি দেখিয়ে উত্তর দিল তরুণ।
.
০৪.
জিনোভিই সাত দিন হল বাড়ি ফেরেনি, আর এই সমস্ত সপ্তাহ ধরে তার স্ত্রী প্রতিটি রাত্রি সেরগেইয়ের সঙ্গে কাটিয়েছে সরস রভসে– শুভ্র প্রভাতের প্রথম আলোর প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত।
এই সাত রাত ধরে জিনোভিই বরিসিচের বেডরুমে শ্বশুরমশাইয়ের ভাড়ার থেকে নিয়ে আসা প্রচুর ওয়াইন পান করা হল, প্রচুর মিষ্ট-মিষ্টান্ন খাওয়া হল, তরুণী গৃহকত্রীর মধুভরা ঠোঁট থেকে প্রচুর চুম্বন চুমুকে চুমুকে তোলা হল, তুলতুলে বালিশের উপর ঘন কৃষ্ণ অলকগুচ্ছ নিয়ে খেলাভরে প্রচুর আদর-সোহাগ করা হল। কিন্তু হায়, কোনও পথই আদ্যন্ত মসৃণ নয়– মাঝে মাঝে হোঁচট-ঠোক্করও খেতে হয়।
বরিস তিমোতেইচের চোখে সে-রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বুড়ো রাত্রির লম্বা রঙিন ঝোল্লা পরে এ-ঘর ও-ঘর বেড়াচ্ছিল; জানালার কাছে এসে বাইরের দিকে তাকাল, তার পর আরেকটা জানালার কাছে এসে দেখে, লাল শার্ট পরা সেই খাপসুরৎ ছোকরা সেরগেই তার পুত্রবধূর জানালার একটা খুঁটি বেয়ে অতিশয় নীরব নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে। বরিস তিমোতেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়ে চেপে ধরল রোমিও নটবরের পা দুখানা। সে তখন সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় চেয়েছিল বুড়োকে একখানা খাঁটি বিরাশি সিক্কা লাগায়– আকস্মিক উৎপাতে তারও মেজাজটা গিয়েছিল বিগড়ে– কিন্তু সেটা আর লাগল না, ভাবল, তা হলে একটা হট্টগোল আরম্ভ হয়ে যাবে।
বরিস তিমোতেই জিগ্যেস করল, বল্ ব্যাটা চোর, কোথায় গিয়েছিলি?
সেরগেই উত্তর দিল, লাও! শুধোচ্ছি, কোথায় গিয়েছিলুম আমি! যেখানেই গিয়ে থাকি না কেন, সেখানে আমি আর এখন নেই। হল, বরিস তিমোতেই মহাশয়, প্রিয়বরেষু!
আমার ছেলের বউয়ের ঘরে তুই রাত কাটিয়েছিস?
ওই কথাটাই যদি জিগ্যেস করলেন কর্তা-ঠাকুর, তা হলে আবার বলি, আমি জানি, আমি রাত্তিরটা কোথায় কাটিয়েছি; কিন্তু এইবেলা তোমাকে একটি খাঁটি তত্ত্বকথা বলছি আমি, বরিস তিমোতেইচ; যা হয়ে গিয়েছে সেটা তুমি আর কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারবে না। খামোখা কেন তোমাদের শিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবারের ওপর এখন ফালতো কেলেঙ্কারি টেনে আনবে– অন্তত সেটা তো ঠেকাতে পারো। এখন আমাকে সরল ভাষায় বল, আমাকে কী করতে হবে। তুমি কী দান পেলে সন্তুষ্ট হবে?
তোকে আমি পাঁচশো ঘা চাবুক কশাব, ব্যাটা পিচেশ।
দোষ আমারই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক! সাহসী নাগর স্বীকৃত হল। এবারে বল তোমার সঙ্গে কোথায় যেতে হবে; প্রাণ যা চায় সেই আনন্দ করে নাও আমার রক্ত চেটে নাও।
বরিস তখন সেরগেইকে শানে তৈরি তার ছোট্ট একটি গুদামঘরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক চাবকাতে আরম্ভ করল। যখন বুড়োর আর চাবুক মারার মতো শক্তি একরত্তিও রইল না তখনই থামল। সেরগেইয়ের গলা থেকে কিন্তু একবারের তরেও এতটুকু আৰ্তরব বেরোয়নি, তবে হ্যাঁ, শার্টের আস্তিনে সে যে দাঁত কিড়িমিড়ি করে কামড়ে ধরেছিল তার অর্ধেকখানা শেষ পর্যন্ত সে চিবিয়ে কুটি কুটি করে ফেলেছিল।
সেরগেই মাটিতে পড়ে রইল। চাবুকে চাবুকে তার পিঠ তখন কামারের আগুনে পোড়া কড়াইয়ের মতো লাল হয়ে গেছে। সেটা শুকোবার সময় দিয়ে বুড়ো তার পাশে একঘটি জল রেখে গুদামঘরের দোরে বিরাট একটা তালায় চাবি মারল। তার পর ছেলেকে আনবার জন্য লোক পাঠাল।
কিন্তু এই আজকের দিনেও*[* ১৮৬৫ খ্রি.] রাশার বড় রাস্তা ছাড়া অন্য রাস্তায় ছ মাইল পথ আসা-যাওয়া সাততাড়াতাড়িতে হয়ে ওঠে না, ওদিকে আবার কাতেরিনা যে সময়টুকু না হবার নয় তার বেশি একটি মাত্র ঘণ্টাও সেরগেই বিহনে কাটাতে পারে না। তার সুপ্ত প্রবৃত্তি তখন অকস্মাৎ পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়ে উঠেছে এবং ফলে সে এমনই দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উঠেছে যে, তখন তার পথ রোধ করে কার সাধ্য! আতিপাতি খুঁজে সে বের করে ফেলেছে সেরগেই কোথায়। সেখানে লোহার দরজার ভিতর দিয়ে সেরগেইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে ছুটল চাবির সন্ধানে।
শ্বশুরের কাছে গিয়ে মিনতি জানাল, সেরগেইকে ছেড়ে দাও, বাবা, লক্ষ্মীটি।
বুড়োর মুখের রঙ সেফ সবুজ হয়ে গেল। এতখানি বেহায়ামির দুঃসাহস সে তার পাপিষ্ঠা পুত্রবধূর কাছে প্রত্যাশা করেনি– কারণ পাপিষ্ঠা হোক আর বেহায়াই হোক, এতদিন সে ছিল বড় বাধ্য মেয়ে।
এ কী আরম্ভ করলি তুই, তুই অমুক-তমুক?– বুড়ো অশ্লীল ভাষায় তার বেহায়াপনা নিয়ে কটুকাটব্য আরম্ভ করল।