কাতেরিনা ভীতকণ্ঠে জিগ্যেস করল, কে?
কেরানি উত্তর দিল, দয়া করে ভয় পাবেন না। আমি। আমি সেরগেই।
কী চাই তোমার, সেরগেই?
আমি আপনার দয়া ভিক্ষা করতে এসেছি, কাতেরিনা ভড়না; একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনার অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে এসেছি– আমাকে কৃপা করে এক মিনিটের জন্য ভিতরে আসতে দিন।
কাতেরিনা চাবি ঘুরিয়ে দোর খুলে দিয়ে সেরগেইকে ঘরে ঢুকতে দিল।
কী ব্যাপার, কী চাই? জানালার কাছে ফিরে গিয়ে কাতেরিনা শুধালো।
আমি আপনার কাছে এলুম জিগ্যেস করতে, আপনার কাছে চটি বই-টই কিছু আছে? আমাকে যদি দয়া করে পড়তে দেন। এখানে কী দুর্বিষহ একঘেয়ে জীবন।
কাতেরিনা উত্তর দিল, আমার কাছে কোনওপ্রকারেরই বই নেই, সেরগেই। আমি তো পড়িনে।
সেরগেই ফরিয়াদ করল, কী একঘেয়ে জীবন!
তোমার জীবন একঘেয়ে হবে কেন?
অপরাধ যদি না নেন তবে নিবেদন করি, একঘেয়ে লাগবে না কেন? আমার এখন যৌবন কাল, অথচ আমরা এখানে আছি মঠের সন্ন্যাসীদের মতো। আর ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, এই নির্জনতাতেই আমাকে পচে হেজে খতম হতে হবে, যতদিন না আমার কফিন-বাক্সের*[* বাঙালি মুসলমান কফন বা কাফন বলতে শবাচ্ছাদনের বস্ত্র বোঝে। (ইংরেজি শ্রাউড) শব্দটি ফারসির মাধ্যমে আরবি থেকে এসেছে। ইউরোপীয় ভাষায় কফিন বলতে যে কাঠের বা পাথরের বাক্সে মৃতদেহ রেখে গোর দেওয়া হয় সেই বাক্স বোঝায়। উভয় শব্দই খুব সম্ভব গ্রিক কফিনস থেকে এসেছে। ইংরেজি কফার পেটিকা- এই শব্দ থেকেই এসেছে। –অনুবাদক।] ডালায় পেরেক ঠোকা হয়। মাঝে মাঝে আমি যে নৈরাশ্যের কোন চরমে পৌঁছই তা আর কী করে বোঝাই!
বিয়ে কর না কেন?
বিয়ে করব? বলা বড় সোজা! এখানে আমি বিয়ে করব কাকে? আমি তো বিশেষ কিছু জমিয়ে উঠতে পারিনে, আর বড়লোকের মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন? ওদিকে গরিব বলেই আমাদের শ্রেণির মেয়ে মাত্রই লেখাপড়ার ধার ধারে না– সে তো আপনি জানেন, কাতেরিনা ভভূনা। তারা কি কখনও সত্যি সত্যি বুঝতে পারে, প্রেম বলতে কী বোঝায়! শুধু তাই নয়, বড়লোকদের ভিতর এ বিষয়ে কী ধারণা সেটাও একবার চিন্তা করুন তো। এই ধরুন আপনার কথা; আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, সামান্যতম স্পর্শকাতরতা যার হৃদয়ে আছে তার কাছে আপনি সান্তনার চিরন্তন উৎস। অথচ দেখুন দিকিনি তারা আপনাকে নিয়ে কী করছে? ময়না পাখিটির মতো খাঁচায় পুরে রেখেছে।
কাতেরিনার মুখ থেকে ফস্কে গেল, কথাটা সত্যি। আমি নিঃসঙ্গ।
তাই একঘেয়ে লাগবে না তো কী লাগবে মাদাম যেভাবে আপনি জীবনযাপন করছেন? আপনার অবস্থায় অন্যেরা যা করে থাকে, আপনার যদি সেরকম উপরি কেউ থাকতও, তবুই-বা কী হত? তার সঙ্গে দেখা করাও তো আপনার পক্ষে অসম্ভব।
এই! তুমি… একটু সীমা পেরিয়ে যাচ্ছ। আমার একটি বাচ্চা থাকলেই, আমার তো মনে হয় আমি সুখী হতুম।
কিন্তু একটু চিন্তা করুন; আমাকে যদি অনুমতি দেন তবে বলি, বাচ্চা জন্মাবার জন্য তার পিছনে তো কোনও-কিছু-একটা চাই বাচ্চা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না। আপনি কি মনে করেন আমি জানিনে আমাদের ব্যবসায়ীদের বউ-ঝিরা কীভাবে জীবন কাটায়– এত বছর আমার মুনিবদের মাঝখানে বাস করেও? আমাদের একটা গীত আছে, আপন হৃদয়ে প্রেম না থাকলে, জীবন সে তো শুধু বিষণ্ণ দুরাশা! আর সেই দুরাশা, সেই কামনা– আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি কাতেরিনা ভভূনা, আমার হৃদয় এমনই বেদনায় ভরে দিয়েছে যে, ইচ্ছে করে ইস্পাতের ছুরি দিয়ে হৃদয়টাকে বুকের মাঝখান থেকে কেটে বের করে আপনার কচি দুটি পায়ের উপর রাখি। আমি তা হলেই শান্ত হব শতগুণ শান্তি ফিরে পাব।
তোমার হৃদয় সম্বন্ধে কী যা-তা সব তুমি আমাকে বলছ? তার সঙ্গে আমার তো কোনও সম্পর্ক নেই। তুমি এইবার আস্তে আস্তে রওনা দাও।
না, দয়া করুন, ঠাকরুন। সেরগেই ততক্ষণে কাতেরিনার দিকে এক পা এগিয়ে এসেছে, তার সমস্ত শরীর তখন কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে উঠছে। আমি জানি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি, স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনার জীবনও এ পৃথিবীতে আমার জীবনের মতোই অত সহজ সরলভাবে বয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু এখন শুধুমাত্র একটি কথা– একথাগুলো সে। বলে গেল এক নিশ্বাসে– এখন, এই মুহূর্তে, সবকিছু আপনার হাতে, আপনার তাঁবেতে।
কী চাও তুমি? এসব কী হচ্ছে? এখানে আমার কাছে তুমি এসেছ কেন? আমি এখুনি জানালা দিয়ে লাফ দেব–কাতেরিনা যখন একথাগুলো বলছিল তখন তার মনে হচ্ছিল, কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় ভয় তাকে অসহ্য বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে। সে তখন জানালার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরে আছে।
ওগো, আমার তুলনাহীনা, ও আমার জীবনসমা! জানালা দিয়ে লাফ দেবার কী প্রয়োজন?—সহজ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সেরগেই এ কথাগুলো কাতেরিনার কানে কানে মৃদুস্বরে বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানালা থেকে টেনে এনে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল।
ও, ও! আমাকে ছাড়– মৃদু কাতর কণ্ঠে কাতেরিনা বলল; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সেরগেইর নিবিড় চুম্বনবর্ষণে তার শক্তি যেন ক্রমেই লোপ পাচ্ছিল! আপন অনিচ্ছায় তার দেহ কিন্তু সেরগেইয়ের দেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।
সেরগেই তার কত্রীকে শূন্যে তুলে নিয়ে দুই বাহুতে করে যেন একটি ছোট্ট বাচ্চাকে তুলে ধরেছে– ঘরের অন্ধকার কোণে নিয়ে গেল।