সেরগেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে উঠল, কখনও না, ভগবান সাক্ষী, আমি আপনাকে আমাদের পুণ্যভূমি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাব।
সাদামাটা পাতলা-দুবলা একজন চাষা ময়দা মাপতে মাপতে বলল, ও হিসাব চলে না, সোনা। আমাদের কার কত ওজন তা দিয়ে কী হয়? তুমি কি মনে কর আমাদের মাংস সবকিছু করে? আমাদের মাংসের ওজনের কোনও দাম নেই, বুঝলে দোস্ত। আমাদের ভিতর যে শক্তি আছে সেই শক্তিই সবকিছু করে আমাদের মাংস কিছুই করে না!
আবার কাতেরিনা নিজেকে সংযত না করতে পেরে বলে ফেলল, বাহ্! আমার বয়েস যখন কম ছিল তখন আমার গায়ে ছিল বেশ জোর; সব পুরুষই যে আমার সঙ্গে তখন পেরে উঠত সেকথাটা আদপেই মনের কোণে ঠাই দিয়ো না।
সুশ্রী ছোকরা অনুরোধ জানিয়ে বলল, খুব ভালো কথা। তাই যদি হয় তবে আপনার ছোট হাতটি আমায় একটু ধরতে দিন তো!
কাতেরিনা হকচকিয়ে গেল কিন্তু হাত তবু দিল বাড়িয়ে।
লাগছে, লাগছে– ওহ! আংটিটা ছেড়ে দাও। ওটাতে লাগছে– সেরগেই কাতেরিনার হাত চেপে ধরতেই সে চিৎকার করে উঠল আর অন্য হাত দিয়ে দিল তার বুকে ধাক্কা। সেরগেই সঙ্গে সঙ্গে তার কত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কার চোটে তাল সামলাতে না পেরে পাশের দিকে দু পা সরে গেল।
সেই ছোটখাটো সাদামাটা চাষা অবাক হয়ে বলল, হুম! লাও ঠেলা। মেয়েদের কথা আর বলছ না যে?
সেরগেই মাথার চুল ঝাঁকুনি মেরে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, না, না। আমাদের ধরাধরিটা ঠিকমতো হোক, তবে তো।
কাতেরিনা বলল, তবে এসো৷ ততক্ষণে তারও মনে ফুর্তির ছোঁয়া লেগেছে। দুটি সুডৌল কনুই উপরের দিকে তুলে ধরে বলল, তবে এসো।
সেরগেই তার তরুণী কত্রীকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে তার সুঠাম বুক আপন লাল শাটের উপর চেপে ধরল। কাতেরিনা তার কাঁধ সরাবার পূর্বেই সেরগেই তাকে শূন্যে তুলে ধরে দু হাতে উপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে আপন বুকে চেপে ধরেছে। তার পর আস্তে আস্তে নামিয়ে নিয়ে একটা উল্টো ধামার উপর বসিয়ে দিল।
আপন দেহের যে শক্তি সম্বন্ধে কাতেরিনা দম্ভ করেছিল তার একরত্তিও সে কাজে লাগাতে পারেনি। এবারে সে লালে লাল হয়ে গিয়ে ধামায় বসে কিংখাপের জামাটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে গায়ে ঠিকমতো বসাল। তার পর চুপচাপ গুদামবাড়ি ছেড়ে রওনা দিল। মেকার মাফিক যতখানি দরকার ঠিক ততখানি দেমাকের সঙ্গে সেরগেই গলা সাফ করে মজুরদের উদ্দেশে হাঁক দিয়ে বলল, ওরে ও গাধার পাল! ময়দার স্রোত বন্ধ হতে দিসনি, হালের উপর এলিয়ে পড়ে আরাম করিসনি। যদি কিছু থাকে বাকি, মোরা তো যাব না ফাঁকি।
ভাবখানা করল যে এক্ষুনি যা হয়ে গেল সে যেন তার কোনও পরোয়াই করে না।
কাতেরিনার পিছনে হাঁপাতে হাঁপাতে যেতে যেতে রাঁধুনী তাকে বলল, ব্যাটাচ্ছেলে সেরেজুকা মেয়েছেলের পিছনে কীরকম ডালকুত্তার মতোই না লাগতে জানে! ওই চোরটার নেই কি? শরীরের গঠন, চেহারা, মুখের ছবি– সবকিছুই আছে। দুনিয়ার যে কোনও মেয়েই হোক, ওই বদমায়েশটা এক লহমায় তাকে মাৎ করে দেবে, তার পর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠেলে দেবে পাপের রাস্তায়। আর কাউকে ভালোবেসে তার প্রতি অনুগত থাকার কথা যদি তোলেন, তবে ওরকম হাড়েটক বেইমানের জুড়ি পাবেন না।
আগে যেতে যেতে যুবতী কী শুধাল, আচ্ছা, কী বলছিলুম, ওই যে… তোমার ছেলেটি বেঁচে আছে তো?
বেঁচে আছে, মা ঠাকরুন, দিব্য জলজ্যান্ত বেঁচে আছে ওর আর ভাবনা কিসের? ওদের যখন কেউ চায় না তখনই তারা প্রাণটাকে আঁকড়ে ধরে আরও জোর দিয়ে।
বাচ্চাটাকে দিল কে?
কে জানে? ঘটে গেল–বলতে পারেন মোটামুটি। মেলা বন্ধু-বান্ধব থাকলে ওরকম ধারা ঘটে যায় বইকি।
ওই ছোঁড়াটা আমাদের সঙ্গে কি অনেকদিন ধরে আছে?
কার কথা বলছেন? সেরগেই?
হ্যাঁ।
মাসখানেক হবে। আগে সে কচনদের ওখানে কাজ করত। সেখানকার মুনিব ওকে খেদিয়ে দেন। তার পর গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, লোকে বলে সেখানে খুদ কত্রীর সঙ্গে প্রেম করেছিল… জাহান্নমে যাক ব্যাটা। সাহসটা দেখুন তো।
.
০৩.
মধুর মধুর গরম, দুধের মতো সাদা প্রায়ান্ধকার নেমে এসেছে শহরের ওপর। জলের বাঁধের মেরামতির কাজ থেকে জিনোভিই এখনও ফেরেনি। সে রাত্রে শ্বশুরও বাড়িতে নেই। তার এক প্রাচীন দিনের বন্ধুর জন্মদিনের পরবে বুড়ো সেখানে গেছে। বলে গেছে রাত্রেও বাড়িতে খাবে না; কেউ যেন তার জন্য অপেক্ষা না করে। আর কিছু করবার ছিল না বলে কাতেরিনা সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে শোবার ঘরের খোলা জানালার উপর হেলান দিয়ে বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। রান্নাঘরে মজুরদের খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন তারা আঙিনার উপর দিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আপন আপন শোবার জায়গায় যাচ্ছে। কেউ গোলাবাড়িতে, কেউ মরাইয়ে, কেউ মিঠে মিঠে গন্ধের খড়ের গাদার দিকে। রান্নাঘর থেকে বেরুল সেরগেই সর্বশেষে। সে প্রথম আঙিনার চতুর্দিকে ব্লোদ দিয়ে তদারকি করল, কুকুরগুলোর চেন খুলে দিল, শিষ দিতে দিতে কাতেরিনার জানালার নিচে দিয়ে যাবার সময় উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন জানাল।
জানালার পাশে বসে কাতেরিনা মৃদুকণ্ঠে প্রত্যাভিবাদন জানাল– বিরাট আঙিনা খানিকক্ষণের ভিতরই নির্জন প্রান্তরের মতো নিঃশেষ হয়ে গেল।
মিনিট দুই যেতে না যেতে কাতেরিনার চাবি-বন্ধ ঘরের বাইরে কে যেন ডাকল, ঠাকরুন!