কাতেরিনা ফাঁকা এ-ঘর থেকে ফাঁকা ও-ঘরে যায়, তার পর আরেক দফা আরো খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, তার পর একঘেয়েমির জন্য হাই তোলে। তার পর সরু সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওঠে উঁচুতে নিজেদের শোবার ঘরে। সেখানে খানিকক্ষণ অলস নয়নে তাকিয়ে থাকে নিচের দিকে যেখানে দড়ি বানাবার পাটসুতো ওজন করা হচ্ছে কিংবা অতি উৎকৃষ্ট মিহিন ময়দা গুদামে পোরা হচ্ছে। আবার সে হাই তোলে– তাই করে যেন সে খানিকটে আরাম পায়। তার পর ঘণ্টাখানেক, ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে ওঠার পর আবার আসবে সেই একঘেয়েমি রুশদেশের খাঁটি একঘেয়েমি, ব্যবসায়ী বাড়ির একঘেয়েমি। সে-একটানা, বৈচিত্র্যহীন একঘেয়েমি এমনই নিরস্ত্র যে তাই লোকে বলে, তখন কোনও গতিকে কোনও একটা বৈচিত্র্য আনার জন্য মানুষ সানন্দে গলায় দড়ি দিয়ে দেখতে চায় তাতে করে কিছু একটা হয় কি না। কাতেরিনার আবার বই পড়ারও বিশেষ শখ ছিল না; আর থাকলেই-বা কী? বাড়িতে ছিল সর্বসুদ্ধ একখানা বই– কিয়েফ শহরে সংকলিত সন্তদের জীবনী।
ধনদৌলতে ভরা শ্বশুরের এই বাড়িতে কাতেরিনার পুরো পাঁচটি বছর কেটে গেল অসহ্য একঘেয়েমিতে– মমতাহীন স্বামীর সঙ্গে সহবাস করে। কিন্তু আকছারই যা হয়– এক্ষেত্রেও কেউ সেদিকে ক্ষণতরেও ভ্রুক্ষেপ করল না।
.
০২.
কাতেরিনার বিয়ের ছ-বছর পর যে-বাঁধের জলে ইসমাইলদের গম-পেষার কল চলত সেটা ফেটে গেল। আর অদৃষ্ট যেন ওদের ভেংচি কাটবার জন্যই ঠিক ওই সময়ে মিলের ওপর পড়ল প্রচণ্ড কাজের চাপ। তখন ধরা পড়ল যে ভাঙনটা প্রকাণ্ড। জল পৌঁছেছে সক্কলের নিচের ধাপে। জোড়াতালি দিয়ে কোনও গতিকে ভাঙনটাকে মেরামত করার সর্ব প্রচেষ্টা হল নিষ্ফল। জিনোভিই আশপাশের চতুর্দিক থেকে আপন লোকজন গম-কলে জড় করে সেখানে ঠায় বসে রইল দিনের পর দিন, রাত্তিরের পর রাত্তির। বুড়ো বাপ ওদিকে শহরের ব্যবসা-কারবার সামলাল। আর কাতেরিনার কাটতে লাগল আরও নিঃসঙ্গ একটানা জীবন। গোড়ার দিকে স্বামী না থাকায় তার জীবনের একঘেয়েমি যেন চূড়ান্তে পৌঁছল, পরে আস্তে আস্তে তার মনে হল, এটা তবু ভালো–এতে করে যেন সে খানিকটে মুক্তি পেল। স্বামীর দিকে তার হৃদয়ের টান কখনও ছিল না। স্বামী না থাকায় তার ওপর হাম্বাই-তাম্বাই করার মতো লোক অন্তত একজন তো কমলো।
একদিন কাতেরিনা ছাতের উপরের ছোট্ট ঘরে জানালার পাশে বসে ক্রমাগত হাই তুলছিল। বিশেষ কিছু নিয়ে যে চিন্তা করছিল তা নয়। করে করে আপন হাই তোলা নিয়ে নিজেই যেন নিজের কাছে লজ্জা পেল। ওদিকে, বাইরের আঙিনায় চমৎকার দিনটি ফুটে উঠেছে; কুসুম কুসুম গরম, রৌদ্রোজ্জ্বল, আনন্দময়। বাগানের সবুজ বেড়ার ভিতর দিয়ে কাতেরিনা দেখছিল, ছোট্ট-ছোট্ট চঞ্চল পাখিগুলো কীরকম এক ডাল থেকে আরেক ডালে ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছিল।
কাতেরিনা ভাবছিল, আচ্ছা, আমি সমস্ত দিন ধরে টানা হাই তুলি কেন? কী জানি। তার চেয়ে বরঞ্চ বেরিয়ে আঙিনায় গিয়ে বসি কিংবা বাগানে বেড়িয়ে আসি।
কিংখাপের একটি পুরনো জামা পিঠে-কাঁধে ফেলে কাতেরিনা বেরিয়ে পড়ল।
বাইরে উজ্জ্বল আলো আর বাতাস যেন নবজীবন দেবার জন্য বইছে। ওদিকে গুদামঘরের কাছে উঁচু চকে সবাই প্রাণ-ভরা খুশিতে ঠাঠা করে আসছিল।
অত রগড় কিসের? কাতেরিনা তার শ্বশুরের কেরানিদের জিগ্যেস করল।
অর্থাৎ, ব্যাপারটা হচ্ছে, মা-ঠাকরুন– একাতেরিনা, ল — আমরা একটা জ্যান্ত শূয়োরী ওজন করছিলুম।
শূয়োরী? সে আবার কী?
ওই যে আকসিনিয়া শূয়োরীটা। বাচ্চা ভাসিলিইকে বিইয়ে গির্জের পরবে আমাদের নেমন্তন্ন করল না, তাকে–উত্তর দিল হাসিভরা বেপরোয়া গলায় একটি ছোকরা। বেশ সাহসী সুন্দর চেহারা। মিশকালো চুল, অল্প অল্প দাড়ি সবে গজাচ্ছে। সেরগেই তার নাম।
ওই মুহূর্তেই দাঁড়ে ঝোলানো ময়দা মাপার ধামা থেকে উঁকি মেরে উঠল রাঁধুনী আকসিনিয়ার চর্বিতে ভর্তি চেহারা আর গোলাপি গাল।
বদমাইশ ব্যাটারা, শয়তান ব্যাটারা–রাঁধুনী তখন গালাগালি জুড়েছে। সে তখন ধামা ঝোলানোর ডাণ্ডাটি ধরে কোনও গতিকে পাল্লা থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে।
খাবার আগে তার ওজন ছিল প্রায় চার মণ। এখন যদি ভালো করে খড় খায় তবে আমাদের সব বাটখারা ফুরিয়ে যাবে।– সেই সুন্দর ছোকরা বুঝিয়ে বলল। তার পর পাল্লাটা উল্টে রাঁধুনীকে ফেলে দিল এককোণের কতকগুলি বস্তার উপর।
রাঁধুনী হাসতে হাসতে গালমন্দ করছিল আর কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করাতে মন দিল।
আচ্ছা, ভাবছি আমার ওজন কত হবে। হাসতে হাসতে দড়ি ধরে মালের দিকটায় উঠে কাতেরিনা শুধলো।
একশো পনেরো পাউন্ডের সামান্য কম। বাটখারা ফেলে সেরগেই বলল, আশ্চর্য!
এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?
আপনার যে অতখানি ওজন হবে আমি মোটেই ভাবতে পারিনি, কাতেরিনা লভভুনা। আমার কী মনে হয় জানেন? আপনাকে দু হাতে তুলে সমস্ত দিন কারও বয়ে বেড়ানো উচিত। এবং সে তাতে করে ক্লান্ত তো হবেই না, বরঞ্চ শুধু আনন্দই পাবে।
হুঃ! আমি তো আর পাঁচজনেরই মতো মাটির মানুষ। তুমিও ক্লান্ত হয়ে পড়বে।– এ ধরনের কথাবার্তা বলতে কাতেরিনা অভ্যস্ত ছিল না বলে উত্তর দিতে গিয়ে তার মুখ একটুখানি রাঙা হয়ে গেল এবং হঠাৎ তার এক অদম্য ইচ্ছা হল অফুরন্ত আনন্দ আর সরস কথাবার্তা বলে তার হৃদয়-মন ভরে নেয়।