শীতে কাতেরিনার সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছিল। সে শীত তার জবজবে ভেজা কাপড়-জামা ভেদ করে তার অস্থি-মজ্জা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল… তার ওপর আরও কী যেন কী একটা তার সর্বসত্তা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। তার মাথা জুলছিল… সত্যই যেন তার ভিতরে আগুন ধরানো হয়েছে… তার চোখের মণি অস্বাভাবিক রকমে বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছে, এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ জ্যোতি এসে সে মণির এখানে-ওখানে নাচছে, আর তার দৃষ্টি ঢেউয়ের দোলার দিকে নিশ্চল-নিবদ্ধ।
সোনেৎকার গলা ছোট্ট একটি রুপোর ঘণ্টার মতো রিনিঝিনি করে উঠল, মাইরি বলছি, এক ফোঁটা ভদকা পেলে আমি বেঁচে যেতুম; এ শীতটা যে আমি কিছুতেই সইতে পারছিনে।
সেরগেই ক্রমাগত খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল, আসুন না, আমার সদাগরের বেগম, আমাদের একটু খাইয়েই দিন না।
ভর্ৎসনা-ভরা মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে তিয়োনা বলল, ছিঃ! তুমি আবার কেন? বিবেক বলে কি তোমার কোনও বস্তু নেই?
ছোকরা কয়েদি গদিউশকা তার সাহায্যে নেমে বলল, সত্যি, এসব ভালো হচ্ছে না।
ওর সম্বন্ধে তোমার বিবেকে না বাধলেও, অন্তত আর পাঁচজনের সামনে তোমার হায়া-শরম থাকা উচিত।
সেরগেই তিয়োনার দিকে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, তুই মাগী বিশ্বতোষক! তুই আর তোর বিবেক! তুই কি সত্যি ভাবিস ওর জন্যে আমাকে আমার বিবেক খোঁচাবে? কে জানে, আমি আদপেই তাকে কখনও ভালোবেসেছিলুম কি না, আর এখন– এখন তো সোনেৎকার হেঁড়া চটিজুতোটি পর্যন্ত ওই চামড়া-ছোলা বেড়ালটার জঘন্য মুখের চেয়ে আমার ঢের বেশি ভালো লাগে। কিছু বলছ না যে? শোন, আমি কি বলি। সে বরঞ্চ ওই বাকামুখো গদিউশকাটার সঙ্গে পিরিত করুক; কিংবা এবারে সে সন্তর্পণে চতুর্দিক দেখে নিয়ে হিজড়েপানা, ফেলুটের জোব্বা-পরা, মাথায়-ঝুঁটিদার-মিলিটারি-টুপিওলা, কয়েদিদের ঘোড়সওয়ার অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, তার চেয়েও ভালো হয় যদি দলের ওই বড় অফিসারের সঙ্গে জুটে যায় আর কিছু না হোক ওই জোব্বার নিচে সে বৃষ্টিতে ভিজবে না।
আবার সোনেৎকার গলা ছোট্ট একটি ঘণ্টার মতো রিনিঝিনি করে উঠল, আর, তখন সবাই তাকে অফিসারের বিবি বলে ডাকবে।
ফোড়ন দিয়ে সেরগেই বলল, একদম খাঁটি কথা… আর একজোড়া গোঁজার জন্য তার কাছ থেকে পয়সা জোগাড় করাটা হবে ছেলে-খেলা!
কাতেরিনা আত্মপক্ষ সমর্থন করল না; সে আরও স্থির অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঢেউগুলোর দিকে, শুধু তার ঠোঁট দুটি নড়ছে। সেরগেইয়ের জঘন্য কুবাক্যের ভিতর দিয়ে তার কানে আসছিল নদীর উত্তাল তরঙ্গের জুম্ভন-বিজড়নের বিক্ষোভিত ধ্বনি, যন্ত্রণাসূচক আতাঁরব। হঠাৎ একটা ঢেউ বিরাট হাই তুলে ভেঙেপড়ার সময় তার মাঝখানে কাতেরিনার সামনে দেখা দিল বরিস তিমোতেইয়েভিচের বিবর্ণ মুখ, আরেকটার মাঝখান থেকে উঁকি মেরে তাকাল তার স্বামী, তার পর সে ফেদিয়াকে কোলে নিয়ে ডাইনে-বায়ে দুলতে লাগল– ফেদিয়ার অবশ্য মাথা ঢলে পড়েছে। কাতেরিনা তার দেবতার উদ্দেশে কোনও প্রার্থনা স্মরণে আনবার চেষ্টা করে ঠোঁট নাড়াল, কিন্তু ক্ষীণস্বরে বেরিয়ে এল, তোমাতে-আমাতে দুজনাতে। কত না দীর্ঘ শরৎ-হেমন্তের রাত কাটিয়েছি পাশাপাশি বসে, তোমাতে-আমাতে কত না আনন্দে সময় কাটিয়েছি কত না হেলাফেলায়; এই বিরাট বিশ্ব থেকে তোমাতে-আমাতে মানুষ ওপারে পাঠিয়েছি নিষ্ঠুর মৃত্যুর ভিতর দিয়ে।
কাতেরিনা লভভনা কাঁপছিল। তার দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটোছুটি ছেড়ে ক্রমেই একটি বিন্দুতে নিবদ্ধ হয়ে আসছিল। সে দৃষ্টি পাগলিনীর মতো। দু-একবার তার হাত দু-খানি মহাশূন্যের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে উঠে আবার পড়ে গেল। আরেক মিনিটকাল অতীত হল—- হঠাৎ তার সমস্ত শরীর সামনে-পিছনে দুলতে আরম্ভ করল; একবার এক মুহূর্তের তরেও তার দৃষ্টি কালো একটা ঢেউয়ের থেকে না সরিয়ে সে সামনের দিকে নিচু হয়ে সোনেৎকার পা দু-খানি চেপে ধরে এক ঝটকায় ভেলার পাশ ডিঙিয়ে তাকে সুদ্ধ নিয়ে ঝাঁপ দিল নদীর তরঙ্গে।
বিস্ময়ে সবাই যেন পাথর হয়ে গিয়েছে।
একটা ঢেউয়ের চূড়ায় কাতেরিনা ভনা দেখা দিয়ে আবার তলিয়ে গেল, আরেকটা ঢেউ সোনোকে তুলে ধরল।
নৌকোর আঁকশিটা! নৌকোর আঁকশিটা ছুঁড়ে দাও!– ভেলা থেকে সমস্বরে চিৎকার উঠল।
লম্বা দড়িতে বাঁধা নৌকার ভারী আঁকশিটা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে জলের উপর পড়ল। সোনেল্কা আবার জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ভেলার পিছনকার স্রোতের টানে জলের নিচে অদৃশ্য অবস্থায় দ্রুতবেগে পিছিয়ে পড়ে সোনেৎকা দু সেকেন্ড পরে আবার উপরের দিকে তার দুবাহু উৎক্ষেপ করল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা আরেকটা ঢেউয়ের উপরে প্রায় কোমর পর্যন্ত জলের উপর তুলে সোনেৎকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল– দৃঢ় বর্ষা যেরকম ক্ষুদ্র মৎস্য-শাবকের ক্ষীণ প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তাকে ভেদ করে চেপে ধরে।
দুজনার কেউই আর উপরে উঠল না।