যারা এই উপদেশ-বাণীতে কর্ণপাত করে না, এরকম বীভৎস অবস্থায় যাদের মনে মৃত্যু-চিন্তা প্রলোভনের চেয়ে ভয়ের সৃষ্টি করে বেশি তাদের করতে হয় বীভৎসতর এমন কিছু যেটা এই আর্ত ক্রন্দনধ্বনির টুটি চেপে ধরে তাকে নীরব করে দেবে। এই তত্ত্বটি আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ সাদামাটা সরল মানুষ উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করতে জানে; এরকম অবস্থায় সে লাগাম ছেড়ে তার নির্ভেজাল নীচ পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয়; সে তখন সাজতে যায় সঙ, নিজেকে নিয়ে আরম্ভ করে নিষ্ঠুর খেলা, অন্য পাঁচজন মানুষকে নিয়েও, তাদের কোমলতম হৃদয়ানুভূতি নিয়ে। এরা এমনিতেই অত্যধিক কোমল স্বভাব ধরে না– এরকম অবস্থায় পড়ে তারা হয়ে যায় দ্বিগুণ পিশাচ।
***
কাতেরিনা-নিগ্রহের পরের দিন ভোরবেলা কয়েদির দল যখন গ্রামের ভিতরকার ঘাটি ছেড়ে সবেমাত্র রাস্তায় নেমেছে তখন সেরগেই ইতর কণ্ঠে কাতেরিনাকে শুধাল, ওগো আমার পটের বিবি, সদাগরের ঘরণী–সম্মানিতা মহাশয়া সর্বাঙ্গীণ কুশলে স্বাস্থ্য উপভোগ করছেন তো?
কথা কটা শেষ করেই সে তৎক্ষণাৎ সোনেৎকার দিকে ফিরে তাকে তার লম্বা কোটের এক পাশ দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে তার তীব্র কণ্ঠ তীব্রতর করে গেয়ে উঠল :
সোনালি চুলের কোমল মাথাটি দেখিনু জানালা দিয়া,
কুগ্রহ মোর,* ঘুমোও নি তুমি? আবার ভাঙিবে হিয়া! বুকের ভিতর জড়ায়ে রাখিব মম গুণ্ঠনে, প্রিয়া।
[* যে রাত্রে সেরগেই ফাঁকি দিয়ে কাতেরিনার কাছ থেকে মোজাজোড়াটি আদায় করে, তখন কাতেরিনা তাকে আমার সর্বনাশের নিধি বলে সোহাগ করেছিল। এখানে সেটা কুগ্রহ মোর। কাতেরিনাকে সেই সোহাগ স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই সেরগেই বিশেষ করে এই গানটাই ধরল।]
গানটা গাইতে গাইতে সেরগেই সোনেৎকাকে জড়িয়ে ধরে তামাম কয়েদির পালের চোখের সম্মুখে তাকে সশব্দে চুম্বন করল।
কাতেরিনা এসব দেখল, অথচ সত্যই যেন দেখতে পেল না। এমন অবস্থায় সে তখন পৌঁছেছে যেন প্রাণহীনা একটা পুতুল হেঁটে চলেছে আর সবাই তাকে খোঁচাতে আরম্ভ করেছে; তাকে দেখাচ্ছে, সেরগেই কীরকম অশ্লীলভাবে সোনেৎকার সঙ্গে ঢলাঢলি লাগিয়েছে। সে তখন সকলের সর্বপ্রকার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বলির পাঁঠা।
যেন পিছন থেকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কাতেরিনা এগোচ্ছে। এ অবস্থায়ও কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা জুড়ে দিলে তিয়োনা মাঝখানে পড়ত; বলত, ছেড়ে দে না ওকে, পিচেশের দল, দেখছিসনে, ওর যে হয়ে এসেছে।
এক ছোকরা কয়েদি যেন বাক্পটু হয়ে বলল, ওর ছোট্ট পা দুখানি বোধহয় ভিজে গিয়েছে।
সেরগেই পাল্লা দিয়ে বলল, এ তথ্য সর্বজন-স্বীকৃত যে, আমাদের সম্রান্ত বণিক সম্প্রদায়ের মহিলাগণকে সাতিশয় সুকোমলভাবে লালনপালন করা হয়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তার যদি একজোড়া গরম বিবিয়ানির মোজা থাকত তা হলে হাঙ্গামা কমে যেত।
কাতেরিনা যেন গভীর ন্দ্রিা থেকে সাড়া দিল, জেগে উঠল।
গুঁতোতে গুঁতোতে তাকে যেন সহ্যের সীমানার ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে- ঘাসেতে লুকনো জঘন্য সাপ তুমি! ঠাট্টা করে হাসো আমাকে নিয়ে ইতর বদমায়েশ হাসো, আরও হাসো!
কী বলছেন আপনি, সদাগরের পটের বিবি! আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করার কোনও মতলবই আমার নেই। আসলে সোনেল্কা হেথায় যখন সত্যই এত সুন্দর মোজা বিক্রি করছে, তখন ভাবলুম– কেন, দোষ করেছি নাকি? আমাদের সদাগরের বেগম সায়েবা হয়তো একজোড়া কিনলেও কিনতে পারেন।
প্রচুর হাস্যধ্বনি উঠল। দম দেওয়া কলের মতো কাতেরিনা সামনের দিকে পা ফেলল।
আবহাওয়া ক্রমাগত আরও খারাপ হচ্ছে। এতদিন যে ধূসর মেঘ আকাশ ঢেকে রেখেছিল এখন তার থেকে নেমে এল স্তরে স্তরে ভেজা-বরফের পাঁজ। মাটি ছোঁয়া মাত্রই এরা গলে গিয়ে রাস্তার কাদার গর্তকে করে দেয় আরও গভীর– সেটাকে ঠেলে ঠেলে পা চালানো করে দেয় আরও অসহ্য কঠিন কঠোর। অবশেষে সম্মুখে দেখা দিল সিসার রঙের একটা রেখা। সে রেখার অন্য তীর চোখে ধরা পড়ে না। এই রেখাঁটি ভলগা নদী। অল্প অল্প জোর হাওয়া ভলগার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বড় বড় কাটা কাটা ঢেউ সামনে পিছনে খেদিয়ে নিয়ে চলেছে।
সর্বাঙ্গ জবজবে ভেজা, শীতে কাঁপতে কাঁপতে কয়েদির দল আস্তে আস্তে ঘাটে পৌঁছে খেয়ার বিরাট কাঠের ভেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
কালো ভেলার কাঠ থেকে জল ঝরছে। পাড়ে এসে ভিড়তে প্রহরীরা কয়েদিদের ভেলাতে ওঠবার ব্যবস্থা করতে লাগল।
সর্বত্র ভেজা বরফের পোঁচ-মাখা ভেলা ঘাট ছেড়ে উন্মত্ত নদীর ঢেউয়ের উপর দোলা খেতে লাগল। ভেলা ছাড়ার সময় কয়েদিদের একজন বলল, কারা সব বলাবলি করছিল, ভেলাতে কার কাছে যেন বিক্রির জন্য ভদ্কা শরাব আছে।
সেরগেই বলল, সত্যি বলতে কি, সামান্য কোনও মাল দিয়ে গলার নালিটা ভেজাবার এই সুযোগটা হারানো বড়ই পরিতাপের বিষয় হবে। সোনেৎকার ফুর্তির জন্য সে তখন কাতেরিনাকে পি খোঁচা দিয়ে উৎপীড়ন করতে শুরু করেছে– আপনি কী বলেন, আমাদের সদাগরের পটের বিবি? পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে এক পাত্তর ভদ্কা দিয়ে আমাদের চিত্তবিনোদন করলে কীরকম হয়? আহা, কিপটেমি করবেন না। স্মরণ কর, প্রিয়তমা, আমাদের অতীতের প্রেমের কথা! আমি আর তুমি ওগো আমার জীবনের আনন্দময়ী, তোমাতে-আমাতে দুজনাতে কত না দীর্ঘ শরৎ-হেমন্তের রাত কাটিয়েছি পাশাপাশি বসে, তোমাতে-আমাতে কত না আনন্দে সময় কাটিয়েছি কত না হেলাফেলায়; কেবলমাত্র তোমাতে-আমাতে দুজনাতে মিলে তোমার প্রিয় আত্মীয়-আত্মজনকে ওপারের চিরশান্তিতে পাঠিয়েছি– একটিমাত্র পাত্রিপুরুতের কণামাত্র সাহায্য না নিয়ে।