কাতেরিনা চলতে লাগল– যেন তার সর্বাঙ্গের কোনও জায়গায় জীবন-রসের বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। শুধু তার চোখদুটো পূর্ণ জীবন্ত, চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে যেন ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেরগেইয়ের দিকে সে দৃষ্টি তাকে ছাড়ল না, এক পলকের তরেও না।
জিরোবার পরের ঘাটিতে পৌঁছানো মাত্রই কাতেরিনা শান্ত পদক্ষেপে সেরগেইয়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, পিশাচ! সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ সোজা তার চোখে থুথু ফেলল।
সেরগেই লাফ দিয়ে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু আর সবাই তাকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখল।
শুধু বলল, দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।– আর হাত দিয়ে মুখ মুছল।
আর-সবাই ব্যঙ্গ করে বলল, অত রোয়াব কিসের, সে-ও তোমার মোকাবেলা করতে ডরায় না। আর-সকলের ঠাট্টা-হাসির মাঝখানে সোনেৎকার কলহাস্য শোনাল বড়ই ফুর্তিতে ভরা।
সোনেৎকার সাহায্যে যে গোটা ষড়যন্ত্রটা গড়ে উঠেছিল সেটা এখন তার সম্পূর্ণ পছন্দমতোই বিকশিত হচ্ছিল।
সেরগেই কাতেরিনাকে শাসাল, এত সহজে এর শেষ হবে না।
জলঝড়ের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত অবসন্ন, ছিন্নভিন্ন হৃদয় নিয়ে কাতেরিনা সে রাত্রিতে কয়েদিদের শক্ত বেঞ্চে ছেঁড়া তন্দ্রার ভিতর মোটেই টের পেল না, কখন দুটো কয়েদি মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকল।
ওরা ঢোকা মাত্রই সোনেল্কা তার বেঞ্চি থেকে গা তুলে নীরবে কাতেরিনাকে দেখিয়ে দিয়ে, ফের শুয়ে পড়ে কয়েদিদের লম্বা কোট দিয়ে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে নিল।
সেই মুহূর্তেই কে যেন কাতেরিনার লম্বা কোট তার গা থেকে তুলে নিয়ে মুখের উপর ছুঁড়ে ঢেকে দিল আর তার পিঠের সুদ্ধমাত্র খসখসে শেমিজের উপর মোটা ডবল দড়ির শেষ প্রান্ত দিয়ে নির্মম চাষাড়ে বলপ্রয়োগ করে বেধড়ক চাবকাতে লাগল।
কাতেরিনা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু মুখে-মাথায় জড়ানো কোটের ভিতর দিয়ে তার কণ্ঠস্বর বেরোতে পারল না। সে উঠে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতেও ওই একই অবস্থা– এক তাগড়া কয়েদি তার কাঁধের উপর বসে তার বাহু দু-খানা জোরে চেপে ধরে রেখেছিল।
পঞ্চাশ! শেষ পর্যন্ত গুনে শেষ হল। কারওরই বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না, এটা সেরগেইয়ের গলা। দুই নিশাচর দোর দিয়ে অন্তর্ধান করল।
কাতেরিনা কোট থেকে মাথা ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠল; সেখানে কেউ নেই, কিন্তু অদূরে লম্বা কোটের নিচে কে যেন হাসছে, নির্মম ব্যঙ্গের ঘেন্না ঈর্ষার হাসি। কাতেরিনা সোনেৎকার হাসি চিনতে পারল।
এ অপমান যে সর্ব-সীমানা পেরিয়ে গেল। আর সীমাহীন ঘৃণা যন্ত্রণা সেই মুহূর্তে কাতেরিনার অন্তরের অন্তস্তলকে যেন সিদ্ধ করতে লাগল। মতিচ্ছন্ন পাগলের মতো সে সমুখপানে ধেয়ে গেল, মতিচ্ছন্নের মতো টলে পড়ল তিয়েনার বুকের উপর পড়ার সময় সে তাকে তুলে ধরল।
কাতেরিনা ঢলে পড়ল তিয়োনার বুকের উপর। এই পূর্ণ উরসই কিছুদিন পূর্বে তারই বিশ্বাসঘাতক প্রেমিককে আনন্দ দিয়েছে পাপাত্মার কাম্য হেয় মাধুর্য দিয়ে। তারই উপর সে কেঁদে ভেঙে পড়ল তার অসহ বেদনার শোক নিয়ে। তারই সরলা কোমলা সপত্নীকে সে জড়িয়ে ধরল, শিশু যেরকম মাকে জড়িয়ে ধরে। তখন তারা দুজনাই এক সমান; দুজনাকে একই মূল্যে নামানো হয়েছে, দুজনাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
দুজনাই এক সমান… তিয়োনা– যার দিকে তার পয়লা খেয়াল গেল তার কাছেই যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, আর কাতেরিনা– সে তার হৃদয়-নাট্যের শেষ দৃশ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু সত্য বলতে কী, এখন আর কোনও অবমাননা তার কাছে অবমাননা বলে মনে হয় না। তার চোখের জল শেষ করে সে এখন শক্ত হয়ে গিয়েছে, যেন সে পাথর হয়ে গিয়েছে, আর এখন সে কাঠের পুতুলের মতো শান্ত হয়ে রোল কলে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল।
ড্রাম বেজে উঠল, দ্রম্-দ্রমাদ-দ্রমাদ-দ্রম্। শিকলে বাঁধা শিকলহীন উভয় শ্রেণির নিরানন্দ নিষ্প্রভ কয়েদির দল যেন অদৃশ্য হস্তের ধাক্কা খেতে খেতে ঘাঁটির চত্বরে বেরিয়ে এল। সেরগেই আছে সেখানে, আর আছে তিয়োনা, সোনেৎকা, কাতেরিনা, আছে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দণ্ডিত আদর্শবাদী এক কয়েদি এক ইহুদির সঙ্গে শিকলে বাঁধা, একই শিকলে বাঁধা এক পোল আর তাতার।
প্রথম তারা একসঙ্গে জটলা করে দাঁড়িয়েছিল; পরে চলনসই রকমের শৃঙ্খলায় সারি বেঁধে তারা রওনা দিল।
এরকম নিরানন্দ দৃশ্য বড়ই বিরল; পাঁচজনের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হৃদয়ে যাদের কণামাত্র আশার ছায়াটুকু পর্যন্ত নেই– এরা কয়েকজন লোক কাঁচা রাস্তার হিমশীতল কালো কাদায় ডুবতে ডুবতে যেন এগিয়ে চলেছে। তাদের চতুর্দিকের সবকিছু এমনি বিসদৃশ যে, আতঙ্কে মানুষের গা শিউরে ওঠে; অন্তহীন কাদামাটি, সিসার মতো বিবর্ণ আকাশ, সর্বশেষ-পত্রবর্জিত নগ্ন সিক্ত উইলো গাছ–আর তাদের লম্বা লম্বা শাখায় বসে আছে উস্কোখুস্কো পালকসুদ্ধ দাঁড়কাকের দল। বাতাস কখনও গুমরে গুমরে ওঠে, তার কণ্ঠস্বর কখনও বা ক্রুদ্ধ, আর কখনও ছাড়ে তীব্র ক্রন্দনরব, আর কখনও-বা ভীষণ হুঙ্কার।
এই বীভৎস দৃশ্য দৃশ্যের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে নরকের সেই গর্জন, যে গর্জন মানুষের আত্মাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সে গর্জনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাইবেলের মহাপুরুষ আইয়ুবের অভিসম্পাত ধ্বংস হোক সেই দিন যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করি, আর তাঁর প্রতি তাঁর স্ত্রীর উপদেশ : তোমার ভগবানকে অভিশাপ জানিয়ে মরে যাও।